প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটি আমাদের জন্য নতুন করে মাথা তুলে সাহসের সঙ্গে কথা বলার দিন, সততার সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো সাংবাদিকতা করার শপথ নেওয়ার দিন।
আজকের সকালটা একটা নতুন সকাল, আজকের সূর্য আমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এক আলোকিত ভবিষ্যতের। গত বছর এই দিনে আমরা বলেছিলাম, ‘পথ হারাবে না বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ পথ হারায়নি। আমাদের আশা ছিল দেশের মানুষের ওপর, আমাদের চির-অপরাজেয় ছাত্র-তরুণ সমাজের ওপর। তারা জেগে উঠেছে। জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। আবার নতুন স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।
এক বছর আগের এই দিনে এ রকম মুক্ত পরিবেশের কথা আমরা ভাবতে পারিনি। যদিও প্রথম আলো সব সময় মুক্তির স্বপ্নের কথা বলেছে। আশার কথা বলেছে অবিরত।
কী অভাবনীয় এক বিদ্রোহ, ছাত্র-জনতার এক অভ্যুত্থান ঘটে গেল এই বাংলাদেশে। ছাত্ররা ডাক দিল, ১৯৬৯-এর শহীদ ড. শামসুজ্জোহার কথা স্মরণ করে রংপুরের আবু সাঈদ গেলেন প্রতিরোধের মিছিলে, তাঁদের মুখে স্লোগান, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। মানুষের মুক্তি আনবার সংগ্রামে প্রাণ দিলেন সাহসী আবু সাঈদ।
স্কুলের কিশোর ছাত্র শাহারিয়ার খান আনাস চিঠি লিখল মায়ের কাছে, ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না।’ তারপর সেই বালক গেল মিছিলে, গুলিতে প্রাণ দিল বীরের মতো। কত শিশু, কিশোর, তরুণ প্রাণ বিসর্জন দিল, কত নারী আত্মদান করলেন, কত মানুষ শহীদ হলেন—সে সবের কথা স্বজনদের অশ্রুজলে লেখা থাকবে আগামী ভবিষ্যতের ইতিহাসের পাতায় পাতায়। হাত-পা হারিয়ে চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়েছেন অসংখ্য মানুষ, গুলিবিদ্ধ চোখ নিয়ে পৃথিবী আঁধার হয়ে এসেছে কত মানুষের। এত বড় বিদ্রোহ-অভ্যুত্থান এর আগে আর কখনো দেখেনি স্বাধীন বাংলাদেশ। এত অশ্রু, এত রক্ত, এত প্রতিরোধ, এত সংগ্রাম এবং অবশেষে স্বৈরতন্ত্রের পতন।
আগামীতেও আমাদের এই স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার কাজ অব্যাহত থাকবে। আমরা সত্য প্রকাশ করব। আমাদের একটাই লক্ষ্য, তা হলো বাংলাদেশের জয়।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
এই মহান এক আশ্চর্য সময়ের সব ঘটনার সংবাদ, বিশ্লেষণ, ছবি আর ভিডিও ছাপা পত্রিকা, অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভিডিওতে তুলে ধরেছেন প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা।
আজকের এই দিনে, প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমরা জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। সালাম জানাই আহত সংগ্রামীদের, অভিবাদন জানাই কিশোর-তরুণ ছাত্রদের আর বাংলাদেশের কোটি সাহসী মানুষকে।
দুই.
পাঠক বন্ধুরা, প্রথম আলোর বিরুদ্ধে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের বৈরিতা ছিল প্রকাশ্য, মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার-হুমকি থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন বন্ধ, পাঠককে গ্রাহক হতে নিষেধাজ্ঞাসহ এমন কোনো হীন পন্থা নেই, যা তারা প্রথম আলোর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেনি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু।’ চাপ ছিল, চেষ্টা ছিল যেকোনোভাবে প্রথম আলোকে দখল করে নেওয়ার।
আজ, স্বৈরাচারী শাসকমুক্ত বাংলাদেশে প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটি আমাদের জন্য নতুন করে মাথা তুলে সাহসের সঙ্গে কথা বলার দিন, সততার সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো সাংবাদিকতা করার শপথ নেওয়ার দিন। আমরা বহু বছর প্রতীক্ষার পর এখন নতুন করে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতাই করতে চাই। আরও সত্য বলতে চাই।
প্রথম আলো শুধু গত ১৬ বছরই বৈরিতার শিকার হয়েছে এমন নয়, ২৬ বছর ধরে সব আমলেই শাসকদের ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছে, নানা রকমের দমননীতির শিকার হয়েছে। এখনো নতুন করে কোনো কোনো মহল প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রথম আলো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অফিস ঘেরাওয়ের কথা বলছে। এসব উদ্দেশ্যমূলক অপতৎপরতা সত্ত্বেও আমরা আমাদের স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখব।
একই সঙ্গে এ কথা বলব যে এই সময় এবং এখনই বরং স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার বড় পরীক্ষা আমাদের জন্য। প্রিয় পাঠক, আমরা আমাদের দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পথ থেকে সরে যাব না।
আমরা শুধু একটা বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করি। তা হলো, সত্য থেকে যেন আমরা বিচ্যুত না হই। সাংবাদিকতার মূলনীতিগুলো সততা, দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে অনুসরণ করলে অনেক সময় প্রচণ্ড দমনকারী শক্তিও সত্যের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে। বিগত জুলাই-আগস্টে আমরা সেটাই দেখলাম। তারা আস্ফালন করে, কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারে না। তাদের পতন হয়। এটাই আমাদের ইতিহাসের শিক্ষা।
আমাদের জাগ্রত ছাত্র ও তরুণসমাজ, সাহসী জনতা আমাদের দেশকে গণতন্ত্রের পথে, মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে, এই আশায় বুক বেঁধে সামনের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে চাই।
আগামীতেও আমাদের এই স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার কাজ অব্যাহত থাকবে। আমরা সত্য প্রকাশ করব। আমাদের একটাই লক্ষ্য, তা হলো বাংলাদেশের জয়। আমরা সত্য প্রকাশের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের জয়ের পথে ভূমিকা রেখে যাব।
তিন.
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ছাত্র-সমন্বয়কেরা বলেছেন, যখন ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেল, টেলিভিশনগুলোয় খবর পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন তাঁরা পায়ে হেঁটে গিয়ে কিনে এনে পড়েছেন ছাপা কাগজ। পড়েছেন প্রথম আলো। আবার যাচাই-বাছাইয়ের পর দ্রুততার সঙ্গে অনলাইনে নির্ভুলভাবে সংবাদ প্রকাশ করার দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন ও সক্রিয় ছিল প্রথম আলো। এসবের পেছনে রয়েছে প্রথম আলোর সব সাংবাদিক।
পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রই সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের বিকল্প হলো আরও গণতন্ত্র।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
তবে আমাদের যেতে হবে বহুদূর। প্রথম আলো টিকে থাকবে আরও বহু দিন, বহু বছর। আমাদের এই যাত্রা সহজ বা সরল হবে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চলার পথ সামনের দিনগুলোয় মসৃণ হবে না। ‘দুর্গম গিরি, কান্তার–মরু, দুস্তর পারাবার’। কাজেই যাত্রীদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে। কান্ডারিদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে আরও। একই সঙ্গে আমাদের, প্রথম আলোকে আরও অধিক সতর্ক হয়ে কাজ করে যেতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সংবাদমাধ্যমকে সমালোচনা করতে বলেছেন, ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে বলেছেন। আসলে গণমাধ্যমের এটাই কাজ। ক্ষমতাবানদের, দায়িত্বপ্রাপ্তদের এবং নেতা ও কর্তাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া, সব সময় মনে করিয়ে দেওয়া—কান্ডারি, হুঁশিয়ার।
পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রই সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের বিকল্প হলো আরও গণতন্ত্র।
আমাদের জাগ্রত ছাত্র ও তরুণসমাজ, সাহসী জনতা আমাদের দেশকে গণতন্ত্রের পথে, মুক্তির লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে, এই আশায় বুক বেঁধে সামনের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে চাই। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান এই আশাবাদ আমাদের মধ্যে নতুন করে সৃষ্টি করেছে।
সে জন্য আমরা বলি, জেগেছে বাংলাদেশ। জেগেছে আশাবাদ। জেগেছে স্বপ্ন। জেগেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জয়ী হবে।
* মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো