চা শিল্প

ইতিহাসের আলপথ ধরে পাহাড়ি চট্টগ্রামে

ফটিকছড়ির একটি চা বাগান
ছবি: সৌরভ দাশ

চীনের জিয়ান শহরে দুনিয়ার প্রাচীনতম চা–পাতা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ২০১৬ সালে। কত প্রাচীন, তা আন্দাজ করতে পারেন? দুই হাজার ১০০ বছর! চায়ের ইতিহাস আসলে এমনই পুরোনো, হাজার বছরের। সেই হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসের আলপথ ধরে চা এসে পৌঁছেছিল পাহাড়ে ঘেরা চট্টগ্রামে। এখন যেখানে চট্টগ্রাম ক্লাব, লালখান বাজার, টাইগার পাস কিংবা বাটালি হিল—ব্রিটিশ আমলে সেখানে ছিল ছায়াঘেরা পাহাড়। তখন ছিল না কোনো সুউচ্চ ভবন, যানজটের ভোগান্তি, উড়ালসড়ক। সেসব পাহাড়েই প্রথম চায়ের উৎপাদন শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ডের মধ্যে চট্টগ্রামেই প্রথম চা উৎপাদন শুরু হয়।

ইতিহাসের এসব খসড়া পাওয়া যায় ১৮৭৩ সালে বাংলায় চা চাষবিষয়ক তৎকালীন কৃষি বিভাগের এক প্রতিবেদনে। ব্রিটিশ সরকারের কাছে ওই বছরের ২৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে এ প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল। ১৮৪৩ সালে চট্টগ্রাম ক্লাব ও আশপাশের পাহাড়ি এলাকার ‘পাইওনিয়ার’ বাগানের পাতা থেকে এ চা বানানো হতো। পরীক্ষামূলক এ বাগানে আবাদ শুরু হয় ১৮৪০ সালে। অর্থাৎ চারা রোপণের তিন বছরের মাথায় চা-গাছের পাতা থেকে চা তৈরি হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে আসামে পরীক্ষামূলক প্রথম চা তৈরির ছয় বছরের মাথায় চট্টগ্রামের বাগান থেকে চা তৈরি হয়েছিল। অবশ্য বর্তমান ক্লাবটি ছিল পাইওনিয়ার বাগানের ব্যবস্থাপকের বাসা। তবে শহর বড় হতে থাকলে ধীরে ধীরে এ বাগান বিলুপ্ত হয়। চট্টগ্রামে শুরু হলেও চায়ের উৎপাদন এই অঞ্চলে থেমে থাকেনি। এরপর প্রসারিত হয়েছে সিলেট, মৌলভীবাজার, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ বিভিন্ন জেলায়। চায়ের সাম্রাজ্যে ব্রিটিশদের গল্প এখন লেখা হচ্ছে নতুনভাবে। কারণ, চায়ের বাজারের আধিপত্য এখন দেশীয় শিল্প গ্রুপের হাতে।

শুরুটা যেভাবে

১৮৪০ সালে তৎকালীন কালেক্টর স্কোনস আসাম থেকে চায়ের বীজ এবং কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে তিনটি চায়না চারা সংগ্রহ করেন। এসব চারা ও বীজ পাইওনিয়ার বাগানে রোপণ করা হয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের বর্তমান বাংলাদেশ অংশে প্রথম চা চাষের শুরুটা এ বাগান দিয়েই।

চট্টগ্রাম ক্লাব প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত এ বাগানে চা উৎপাদিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ১৮৭২ সালে পাইওনিয়ার বাগানের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, সে বছর ৬ হাজার ৪০০ পাউন্ড (২ হাজার ৮৮০ কেজি) চা তৈরি হয়। সে সময় বাগানটির ১০ একরে পরিপক্ব চা-গাছ এবং তিন একরে অপরিপক্ব চা-গাছ ছিল। সব মিলিয়ে ওই বছর চট্টগ্রামে ১৩টি বাগানে ১ লাখ ৯৮ হাজার পাউন্ড চা তৈরি হয়। তবে একসময় নগরায়ণের ফলে বাগান এলাকার চেহারা বদলে যায়। হারিয়ে যায় পাহাড়ের ভাঁজে থাকা চা–গাছের সারি। থেমে যায় শ্রমিকের কর্মব্যস্ততা।

চট্টগ্রামে প্রথম চাষ শুরু হলেও ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ অংশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রথম চা চাষ শুরু হয় সিলেটে। আবার চা চাষের সম্প্রসারণও হয়েছে সেখানে। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে সিলেটে মালিনীছড়া বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত ‘আসাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারস, সিলেট’-এ বলা হয়, সিলেটের মালিনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে।

বর্তমানে দেশে ১৬৭টি চা-বাগানের ১৩৫টিই বৃহত্তর সিলেটে। চট্টগ্রামে বাগান রয়েছে ২১টি। চা সম্প্রসারণের তালিকায় এখন যুক্ত হয়েছে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার সমতল এলাকাও।

চাটগাঁর চায়ের সুনাম...

সালটা ১৯১৬। সে বছর জাপান ভ্রমণে গিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানে এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে চা-পান অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথও আমন্ত্রণ সানন্দে গ্রহণ করলেন। সেই চায়ের আয়োজনে মোহিত হয়েছিলেন কবিগুরু।

সেরা চায়ের খোঁজেই কবিগুরু সেই চা-চক্রের প্রসঙ্গ টানা হলো। জাপানি চায়ের প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মেছিল অনেক আগেই। গুণে–মানে জাপানি চায়ের সুনাম ছিল। কিন্তু চট্টগ্রামের চা-ও কম যায় না। ১৮৭৩ সালে চট্টগ্রামের কৃষি বিভাগ থেকে ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, পাইওনিয়ার বাগানের চায়ের নমুনা ১৮৬১ সালে লন্ডনে পাঠানো হয়। পরে লন্ডনের মেসার্স টুইনিং অ্যান্ড কোম্পানি ওই নমুনা পরীক্ষা করে ‘এ ওয়ান’ ক্যাটাগরি, অর্থাৎ খুবই ভালো বলে উল্লেখ করে। ১৮৬১ সালের ১ জুলাই দেওয়া ওই সনদে চায়ের চমৎকার স্বাদ ও পানীয়ের রং উজ্জ্বল বলে উল্লেখ করা হয়।

অবশ্য শুরুতে চট্টগ্রামে চা চাষ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত কম বলে চা চাষ সম্প্রসারণেও শঙ্কা ছিল। অবহেলার কারণে অনেক চা-বাগান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এরপরও চট্টগ্রামের উৎপাদিত চায়ের মান স্বীকৃতি দিয়েছিল বিশ্বখ্যাত চা কোম্পানি টুইনিং। এখানেই শেষ নয়। এ স্বীকৃতির ১৬০ বছর পর আবারও স্বীকৃতি মিলেছে চট্টগ্রামের চায়ের। ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ নিলাম মৌসুমে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ব্র্যাকের কৈয়াছড়া ডলু বাগানের চা দেশের বাগানগুলোর মধ্যে গড়ে সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ এ বাগানের চায়ের গড় মান ভালো। একরপ্রতি সর্বোচ্চ ফলনেও বছর তিনেক আগে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ফটিকছড়ির হালদা ভ্যালি চা–বাগান। ২০১৭ সালে হালদা ভ্যালিতে হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন ছিল ৩ হাজার ৭১৭ কেজি। সে সময় দেশের অন্য চা-বাগানে গড় উৎপাদন ছিল হেক্টরপ্রতি ১ হাজার ৪৭৭ কেজি। এ জন্য সব বাগানকে পেছনে ফেলে চা উৎপাদনে ‘সেরা পুরস্কার’ পেয়েছিল বাগানটি।

দেশীয়দের আধিপত্য

চায়ের বাজার একসময় ছিল ব্রিটিশদের হাতে। এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। দুই দশকে ব্রিটিশ কোম্পানি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগান ইজারা নিয়ে বিনিয়োগ করেছে দেশীয় শিল্প গ্রুপগুলো। তালিকায় ১৮টি শিল্প গ্রুপের নাম রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বাগানের সংস্কার যেমন করেছে, তেমনি আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনেও বিনিয়োগ করেছে। এতেই মিলেছে সাফল্য।

চা বোর্ডও দুই দশকে নতুন নতুন প্রকল্প নিয়েছে। চা চাষের আওতা বাড়াতে তদারকি বাড়িয়েছে। ক্ষুদ্র চাষি ও নতুন উদ্যোক্তাদের চা চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাতে দেড় শ বছরের বেশি সময় ধরে চা উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু সিলেট-চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে চা চাষের বিস্তার ঘটেছে উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য জেলায়। চা উৎপাদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুই দশক আগে ২০০০ সালে স্টারলিং কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলোর হাত ধরে উৎপাদিত হয় মোট উৎপাদনের ৪৮ শতাংশ চা। গত বছর তা কমে দাঁড়ায় প্রায় ১৯ শতাংশ। আর ধারাবাহিকভাবে বেড়ে দেশীয় কোম্পানিগুলোর হাতে এখন উৎপাদিত হচ্ছে ৮১ শতাংশ চা। দুই দশক আগে এই পরিবর্তন শুরু হলেও তাতে গতি পায় যুক্তরাজ্যের জেমস ফিনলে লিমিটেডের চা-বাগান হস্তান্তরের ঘটনার পর। যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত সোয়ার গ্রুপ ফিনলে লিমিটেডকে অধিগ্রহণ করে। তারা বাংলাদেশের ব্যবসায় মুনাফা না দেখে ২০০৫ সালে বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০৬ সালের মার্চে ব্রিটিশ এই কোম্পানির হাতে থাকা ৩৯ হাজার ১১২ একর বাগানের সব শেয়ার আনুষ্ঠানিকভাবে কিনে নেয় ছয়টি গ্রুপ ও দুই ব্যক্তি। ছয়টি গ্রুপ হলো ইস্পাহানি, উত্তরা গ্রুপ (উত্তরা মোটরস), পেডরোলো, ইস্টকোস্ট, এবিসি গ্রুপ এবং এমজিএইচ গ্রুপ। এর মধ্যে শেষ তিনটি প্রথমবার এই খাতে বিনিয়োগ করেছে।

ফিনলে ছাড়াও গত দুই দশকে চা-বাগান ইজারা নিয়ে যুক্ত হয়েছে এ কে খান, আকিজ, স্কয়ার, সিটি, টিকে, ওরিয়ন, কাজী অ্যান্ড কাজী (জেমকন), ইউনাইটেড গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ এবং প্যারাগন গ্রুপের মতো শিল্প গ্রুপ। বৈশ্বিক পারফিউম ব্র্যান্ড আল হারামাইন পারফিউমস গ্রুপ, পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান হা-মীম ও ভিয়েলাটেক্স গ্রুপও আছে এই তালিকায়। এ ছাড়া বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘ব্র্যাক’ও বিনিয়োগ করেছে চা খাতে।

চা বোর্ড জানাচ্ছে, চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম ধরা হয় জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসকে। এ সময় প্রতি মাসে এক কোটি কেজির বেশি চা উৎপাদিত হয়। ২০১৮ সালে দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৮ কোটি ২১ লাখ কেজি, ২০১৯ সালে ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি, ২০২০ সালে ৮ কোটি ৬৩ লাখ কেজি, ২০২১ সালে ৯ কোটি ৩৮ লাখ এবং গত বছর  উৎপাদন হয় ৯ কোটি ৩৮ লাখ কেজি চা।

হালদা ভ্যালির সাফল্য

চট্টগ্রামে চায়ের কথা এলেই হালদা ভ্যালির নাম সবার ওপরে থাকে। ফটিকছড়ি উপজেলার শেষ প্রান্তে নারায়ণহাট ইউনিয়নে এ বাগান অবস্থিত। চায়ের ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাওয়া শতবর্ষী এই বাগানের সাফল্যের কথা এখন সবার মুখে মুখে। ইতিমধ্যে চা উৎপাদনে সেরা পুরস্কার পেয়েছে তারা। ২০০৩ সালে এক বন্ধুর পরামর্শে হালদা ভ্যালি ইজারা নেন পানির পাম্প বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান পেডরোলো এনকে লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাদের খান। বাগানটি ১৯০৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ছয়টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাত ঘুরে সবশেষে আসে পেডরোলো গ্রুপের হাতে। তাঁদের নানা পদক্ষেপে এই বাগানের চেহারা পাল্টে গেছে।

প্রথম বছর চা চাষের উপযোগী করে তোলা হয় ১২ একর জায়গা। তাতে রোপণ করা হয় সাড়ে ৭২ হাজার চারাগাছ। তবে পানির অভাবে এক বছরের মাথায় মারা যায় অর্ধেক চা-গাছ। গাছ বাঁচাতে হাসপাতালে ব্যবহৃত স্যালাইনের প্যাকেটে পানি ভরে প্রতিটি গাছের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু এ পদ্ধতি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই থাইল্যান্ডে একটি ফলের বাগানে সেচব্যবস্থা অনুসরণ করে ২০০৭ সালে হালদা ভ্যালিতে চালু হয় স্থায়ী সেচব্যবস্থা। এরপরই বাড়তে থাকে উৎপাদন। বাড়তে থাকে চায়ের মান।