সমুদ্রসৈকতে কান পাতলে যেমন শোনা যায়—লো স্কেলের শব্দটা বাড়তে বাড়তে উত্তাল হয়ে ওঠে—একবার, দুবার, তিনবার, তেমনই ঘটল। আমার রিকশা এসে থামে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাড়িয়ে কিছু সামনে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে। ক্রাচে ভর করে ধীরে নেমে আসি রাজপথে। ঝাঁকে ঝাঁকে পরিচিত মুখ চারদিকে। আনন্দ, বিষাদ, গর্ব, বিস্ময়—সব একসঙ্গে খেলা করে সহপাঠী, বন্ধু, অগ্রজ–অনুজদের দীপ্তিমান চোখে। সার বেঁধে দাঁড়ানো নারী, শিশু, বৃদ্ধদের দিকচিহ্নহীন জনসমুদ্র থেকে ভেসে আসে খড়খড়ে মাইকের আওয়াজ, ‘এ মুহূর্তে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন নির্যাতিত ছাত্রনেতা আরিফ সোহেল, ছয় দিন রিমান্ডে নির্যাতন, নিপীড়ন...।’ সমবেত জনতা ঘুরে তাকায়। বৃদ্ধ, যুবক, মা-বোন, ছাত্র-শ্রমিকেরা কেউ হাত তুলে দোয়া করে, কেউবা বুকে জড়িয়ে ধরে, চুমু খায় কপালে! বেশ খানিক পর আমাকে রিকশায় চড়িয়ে জনস্রোত এগোচ্ছে আবার, কণ্ঠে স্লোগান, মাথায় পতাকা, হাতে লাঠি। গন্তব্য ঢাকার গণভবন। ঝাপসা হয়ে আসা চোখ ততক্ষণে সতর্ক হয়ে উঠেছে।
ঘুম ঘুম চোখে রিকশায় চেপে ৪ জুন যখন ক্যাম্পাসে ঘুরছিলাম, তখন অবশ্য গন্তব্য ছিল বটতলা। সেখানে কাদের ভাইয়ের দোকান আমাদের আড্ডাবাজির আস্তানা। সরকারি প্রজ্ঞাপনে চাকরিতে কোটা আবার বহাল হয়েছে। লাইব্রেরিতে আনাগোনা করা ভাই-ব্রাদারদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। জীবিকার সুযোগ কেড়ে নেবে সার্টিফিকেট বাগানো দলীয় পান্ডারা, মেধাবীরা হেরে যাবে বংশপরিচয়ের কাছে। কাদের ভাইয়ের দোকানে তাই ডাক পড়েছে। চা খাওয়ার ফাঁকে দু–চারজন মিলে ঠিক হলো, পরদিন লাইব্রেরিতে যাব। বৈষম্যমূলক কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন নামাতে হবে। আন্দোলনটা দিনে দিনে জমলও বটে!
সারা দিন চা–সিগারেট ফুঁকে, বিপ্লব–বিদ্রোহ, কবিতা নিয়ে আড্ডা দিয়ে, লাইব্রেরিতে পড়ে থেকে থেকে দম হয়েছিল আমাদের ঢের। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা পুলিশি বাধা ভেঙে টানা অবরোধে গেল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে। পুলিশ আসে। কতক্ষণ অনুনয়–বিনয় করে, কখনো দেয় ধমক। আমরা শুনি না, গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়াই। যন্ত্রণা হয় পথে আটকে পড়া মানুষ দেখে, চেষ্টা করি তাদের কষ্ট লাঘবের। আর ভাবি, এসবের শেষ কোথায়! চাকরি পাওয়ার আন্দোলন করি আর স্লোগান দিই—‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’।
রক্ত ঝরল প্রথম ১৪ জুলাই। আমাদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে গাল দিলেন ফ্যাসিস্ট হাসিনা। সেদিন মধ্যরাতে বটতলায় গেলাম আমরা। খবর এল, রবীন্দ্রনাথ হলে আটকে রাখা হয়েছে সহযোদ্ধাদের। মিছিলের পর মিছিল বের হলো। অগ্নিকন্যারা জেগে উঠল। রবীন্দ্রনাথ হলের সামনে তুমুল গ্যাঞ্জাম! ছাত্রলীগের ক্যাডাররা পরাস্ত, লড়াই তবু অসমাপ্ত।
১৫ জুলাই সকাল থেকেই খবর আসছে, সারা দেশে হামলা হচ্ছে ছাত্রদের ওপর। আমরা দৃঢ়সংকল্প, মিছিল বের করবই। সন্ধ্যায় মিছিল হচ্ছে। খবর আসছে, স্থানীয় গুন্ডাদের নিয়ে বটতলায় জড়ো হয়েছে ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলে’রা। আমাদের ওপর সন্ধ্যার অন্ধকারে হামলা হলো। রক্তে ভাসল ক্যাম্পাস। শহীদ মিনার থেকে রুখে দাঁড়াল ছাত্ররা! লড়াই চলল অনেকক্ষণ। সন্ত্রাসীদের তাড়িয়ে দিয়ে এক হলাম সবাই। মিছিল নিয়ে গেলাম উপাচার্যের বাড়ি।
উপাচার্য দলদাস শিক্ষকদের নিয়ে একবার বাইরে এসে কিছু না বলেই চলে গেলেন। খবর পেলাম, বহিরাগত সন্ত্রাসীরা অস্ত্রসহ ট্রাকে ট্রাকে ঢুকছে ক্যাম্পাসে, নেতৃত্বে ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগ। পুলিশও এল। এ সময় মেয়েদের নিরাপদে বের করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন ফ্যাসিস্টের দোসর শিক্ষকেরা। কিন্তু ‘ভাইদের ছাড়া একচুলও নড়ব না’—জানিয়ে দিল মেয়েরা! অবশেষে ইট–পাথর দিয়ে আক্রমণ শুরু করল সন্ত্রাসীরা। পেছাতে পেছাতে আমরা তখন উপাচার্যের বাড়ির দরজায়! চারদিকে ঘেরাও। কোথা থেকে একটা ককটেল এসে পড়ল কাছেই, আগুন লিকলিকিয়ে উঠল। পুলিশ নির্বিকার। ‘ভাই, আপনি মধ্যে থাকেন’—বলে চেঁচিয়ে উঠল কেউ, ঠেলে দিল ভিড়ের মধ্যে। মানবঢালের মাঝখানে আমি। চারপাশ থেকে আঘাত আসছে, রক্ত ঝরছে, ভেসে আসছে চিৎকার। কয়েকজন সামনে থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলল। ফোনে ফোনে লাইভ চলছে। পুরো বাংলাদেশ জেগে আছে, নিস্তব্ধ! ফেসবুকে নজর সবার জাহাঙ্গীরনগরে! হঠাৎ তোলপাড়। কারা যেন ছুটে এল একদম কাছে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এই মৃত্যুপুরীতে আছি আমরা।
বেশ অনেকক্ষণ পরে মেয়েদের জটলার কাছে একজন আসতেই হাতের লাঠিটা তুললাম, ‘মরতে যদি হয় লড়েই মরব।’ ‘দাঁড়াও… দাঁড়াও…জাহাঙ্গীরনগর, জাহাঙ্গীরনগর!’—দুই হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল সামনের লোকটা। দুই সেকেন্ড লাগল বুঝতে। পরক্ষণেই আনন্দে চিৎকার, অশ্রু ও আলিঙ্গন! ক্যাম্পাসের প্রতিটি হল থেকে আমাদের ভাইবোনেরা ছুটে এসেছে সন্ত্রাসীদের তাড়াতে!
দলবলে সবাই বেরিয়ে এলাম ক্যাম্পাসের রাস্তায়। হল থেকে হল ঘুরে ঘুরে স্লোগান তুলল ছাত্রছাত্রীরা। আর পেছন দরজা দিয়ে পালাল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী বাহিনী। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ক্যাম্পাস সন্ত্রাসমুক্ত। জাহাঙ্গীরনগর স্বাধীন হলো, ছাত্রলীগ হটানোয় প্রথম হলো প্রিয় ক্যাম্পাস।
১৬ জুলাই কাটল লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে। দিকে দিকে ব্যারিকেড। বিপ্লবী ছাত্ররা মাথায় পতাকা, হাতে লাঠি নিয়ে প্রহরায়। মাইকে বাজছে স্লোগান। সন্ধ্যা হতেই হলে হলে প্রস্তুতি আক্রমণ প্রতিরোধের। সন্ত্রাসীরা সে রাতে আর সাহস করল না।
১৭ জুলাই প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করল। আমাদের নাকি চলে যেতে হবে ক্যাম্পাস ছেড়ে! আবারও মিছিলে–স্লোগানে উত্তাল রাজপথ। সেদিন মিছিলে মিশে গেল অচেনা অনেক মুখ। ফিসফাস আলাপ, ষড়যন্ত্রের গন্ধ চারদিকে। বিকেল ঠিক পাঁচটার দিকে পুলিশ হামলে পড়ল। হঠাৎ খুব কাছে কিছু ফাটল, ছিটকে বিঁধে গেল পায়ে। দেখার সময় কই! বিচ্ছিন্ন, আহত, ছত্রভঙ্গ হয়ে সরে যেতে হলো। আমাদের অনেক ভাইবোনে তখন আহত। ক্যাম্পাসের পাখি আর ফুলগুলোও যেন কাঁদছে। ভোরের আলো যখন ফোটে, আমরা তখন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, হতাশ।
সে সময় ইন্টারনেট কাজ করছে না। অনেক কষ্টে জমায়েত ডাকলাম ক্যাম্পাসে। ছোট্ট একটা মিছিল করে তারপর জড়ো হলাম বটতলায়। পুলিশও এল। আমাদের মাথা তখন আর কাজ করছে না। হঠাৎ শোরগোল! স্থানীয় জনতা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ঢুকে পড়ল তাদের সন্তানদের রক্ষা করতে। হাজারখানেক লোক নিয়ে আমরা একে একে হলগুলোতে পুলিশের লাগানো তালা ভাঙলাম, পুলিশকে তাড়িয়ে দিলাম ক্যাম্পাসের বাইরে।
কারফিউর কথা বইয়ে পড়েছিলাম, দেখিনি। এবার দেখলাম এবং ভাঙলাম। সেনাবাহিনী আর বিজিবির সাঁজোয়া যান ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যায়। প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা। তারা হাত নেড়ে নেড়ে চলে যেতে বলে। পুলিশকে বেশি খেপিয়ে দিলে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। তখন কৌশলে হটে যেতে হয়। এভাবে শুরু হলো আমাদের গেরিলা আন্দোলন। রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে চব্বিশের শহীদ স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভের নকশা করে ফেলে এক সহযোদ্ধা শিল্পী। কাগজে তুলির আঁচড় দেখে দেখে নিজেদের মনে হয়, গেরিলা হাইডআউটে থাকা যোদ্ধা, যাদের নিয়ে জহির রায়হান গল্প লিখবেন। একদিন আমরা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তি বসিয়ে দিই সবাই মিলে।
ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মিছিল নামাই আশপাশের পাড়া–মহল্লায়। সেদিন থেকেই শুরু হয় ধরপাকড়, গ্রেপ্তার। আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। মিছিল ছোট হয়। আমাদের আত্মগোপনের দিন দীর্ঘ হয়। এর মধ্যে খবর এল, ঢাকায় আন্দোলনের পাঁচ নেতা গ্রেপ্তার।
এরপরের দৃশ্যাবলি সবার জানা—হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে শিশুহত্যা, গাড়িচাপা দেওয়া হয় কিশোরদের! এই বাস্তবতায় কোমর বেঁধে নামলাম। যোগাযোগ করলাম সবখানে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মিটিংয়ের দিন ঠিক হলো, আন্তর্জাতিক মহলকে জানাতে হবে আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের হত্যাকাণ্ড আর অত্যাচারের কাহিনি। সময় নিয়ে দলিলপত্র সাজাই। ফোন আসে সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে, যেতে হবে ঢাকায়, পাঁচ নেতার অনুপস্থিতিতে তুলে নিতে হবে নেতৃত্বের ভার। প্রস্তুত হই মৃত্যুর জন্য! শেষবারের মতো পরিবারকে দেখতে যাই ক্যাম্পাসের পাশেই ছোট্ট বাসায়।
মধ্যরাতে দরজায় আঘাত। ঢুকে পড়ে পুলিশ! এক কাপড়েই গাড়িতে তোলা হয় আমাকে। বাবা দাঁড়িয়ে যান গাড়ির সামনে, আবু সাঈদের মতো দুই হাত তুলে। আমি ডাকি, ‘আব্বা, সরে আসেন, গাড়িতে তুলবে আপনাকে।’ বাবা সরে এলে গাড়ি চলে যায় ডিবির প্রধান কার্যালয়ে।
হাজত তখন সব গণতন্ত্রকামী, স্বৈরাচারবিরোধী দলগুলোর নেতা–কর্মী দিয়ে বোঝাই। মামলা আর রিমান্ডে চলে জীবন। গরাদ থেকে বের করে কালো কাপড় পরিয়ে নিয়ে যাওয়া, আর জীবন্মৃত অবস্থায় আবার ঢোকানো। আর্তনাদ, দীর্ঘশ্বাস আর আতঙ্ক। অল্পবয়সী আমরা কজন অবশ্য হাসিঠাট্টা করেই কাটাতে চাই। আমাদের জীবনীশক্তি হাজতখানায় যেন প্রাণ ফিরিয়ে আনে ধীরে ধীরে। একদিন হাজতে ঢোকে চকচকে পোশাক, সানগ্লাস, হেডফোনওয়ালা একদল লেটেস্ট জেন-জি। তারা আমাকে চিনতে পারে। ‘আমরা প্রাইভেটের ভাই’—হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় তরুণেরা। সেদিনটা কী আনন্দেই না কেটেছিল!
৩ আগস্ট মুক্তি পাই আমি। পুরো ঢাকায় মানুষ আর মানুষ। আমার পা তত দিনে ফুলে ঢোল। ভেতরে থাকা পুরোনো স্প্লিন্টার পায়ে পচন ধরিয়েছে। খুব গোপনে অস্ত্রোপচার করা হলো পায়ে। চলনশক্তি হারিয়ে ক্রাচ জোগাড় করি। তার মধ্যেই শহীদ মিনারে এক দফার ঘোষণা হয়েছে। সারা দেহ-মনে রাজপথ, সহযোদ্ধা আর প্রিয় ক্যাম্পাসের ডাক শুনতে পাচ্ছি তখন।
অতি সন্তর্পণে অ্যাম্বুলেন্সে চেপে ক্যাম্পাসে যখন পৌঁছালাম, তখন ৩৬ জুলাই অথবা ৫ আগস্টের সকাল। ‘ঢাকা চলো জনতা, ছাড়তে হবে ক্ষমতা’ স্লোগানে মুখর চারপাশ। বাসায় পৌঁছেই আবার বেরিয়ে পড়ি রিকশায়। জনতার মিছিল তখন মীর মশাররফের ওদিকে…।
শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে গণভবন জনতার দখলে। লংমার্চ থেকে ফিরছে ছোট ছোট মিছিল! হঠাৎ আমাকে কাঁধে তুলে মিছিল বের হলো। জাহাঙ্গীরনগরের শহীদ মিনারে আসতেই বিশাল জটলা। আমাকে কোলে নিয়ে ছুটছে মানুষ। শহীদ মিনারে সাদা কাপড়ে মোড়া একটা দেহ। কপালে ছোট্ট একটা গর্ত! শুয়ে আছে একটা ছেলে, চারপাশে কাঁদছে সবাই। অনুরোধ করতেই ভিড় ঠেলে আমাকে ওই নিথর ছেলের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। আলতো করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ছেলেটা ঘুমাচ্ছে।
আমি জেগে আছি, এখনো!
* আরিফ সোহেল: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক