বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের জন্য সুদক্ষ, সুস্থ ও সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে মনে করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি, আমরা যেহেতু জনমিতির একধরনের সুবিধাজনক অবস্থায় আছি ফলে তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। তবে জনমিতির এই সুবিধা কিন্তু আর এক কিংবা দুই দশকের বেশি সময়ের পর আমরা আর পাব না। তাই তরুণ এই জনশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য খুব বেশি সময় আমাদের হাতে নেই।
তবে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের পরিপ্রেক্ষিতে তর্কের অবকাশ নেই যে অর্থনীতির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূচকে আমাদের প্রশংসনীয় অগ্রগতি হলেও শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান। আর বিশ্বায়নের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে নতুন চ্যালেঞ্জ।
এ প্রসঙ্গে বেকারত্ব, বিশেষ করে তরুণ বেকারত্ব ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিম্ন মজুরি, সঠিক কর্ম পরিবেশের অভাব—এ সব সমস্যার পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির অভাব মূল চ্যালেঞ্জের জায়গা। এখানে মনে রাখা জরুরি যে বেকারত্বের যে সংজ্ঞা আন্তর্জাতিকভাবে আমরাও ব্যবহার করি সে সংজ্ঞা আমাদের মতো অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে সঠিক চিত্র দেয় না—প্রকৃত বেকারত্ব আমাদের দেশে আরও বেশি।
সার্বিক বেকারত্বের পাশাপাশি শিক্ষিত বেকার সমস্যার মূলে আবার রয়েছে মানসম্মত ও আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রমের অভাব। মনে রাখা জরুরি যে শ্রমবাজারের চাহিদা আর সরবরাহের ক্ষেত্রে কাজ করছে একধরনের দক্ষতার সমন্বয়হীনতা, ফলে সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ থেকে যে ধরনের দক্ষতা, শিক্ষা চাকরিপ্রার্থীরা পাচ্ছেন, চাকরিদাতাদের চাহিদার সঙ্গে তা অনেক ক্ষেত্রেই মিলছে না, ফলে দেশে এক দিকে যেমন রয়েই যাচ্ছে বেকারত্বের সমস্যা, অন্য দিকে বিদেশ থেকে আনতে হচ্ছে ‘দক্ষ’ জনশক্তি।
আমাদের শ্রমবাজারের আরেকটি অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত বিষয় হচ্ছে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ। গত এক দশকে অন্যান্য অনেক দেশের (বিশেষ করে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর) তুলনায় নারীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও পুরুষদের সঙ্গে তুলনামূলক বিবেচনায় ও কাজের গুণগত মানের পরিপ্রেক্ষিতে নারী-পুরুষের ব্যবধান এখনো একটি চ্যালেঞ্জের জায়গা। এ ছাড়া বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলোর পাশাপাশি প্রযুক্তির উৎকর্ষ, উৎপাদনে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের (অটোমেশন) ব্যবহার, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তার ভবিষ্যতের শ্রমবাজারে নতুন আঙ্গিক তৈরি করেছে, যেখানে দক্ষ, আধুনিক ও নতুন দক্ষতায় প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তির চাহিদা বেড়েই চলেছে। তাই অপেক্ষাকৃত স্বল্প দক্ষতার কর্মীদের জন্য কাজের ক্ষেত্রও দ্রুত কমে আসছে।
এ পরিস্থিতিতে শ্রমবাজারে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ও তরুণ জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য শ্রমঘন শিল্পগুলোয় বিনিয়োগ বাড়াতে নীতি সহায়তার প্রয়োজন আছে। যদিও দেখা গেছে যে বৃহৎ শিল্পগুলোয় সহায়তা অনেক ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থান তৈরিতে আশানুরূপ পরিবর্তন আনছে না। সে ক্ষেত্রে নতুন নতুন শ্রমনির্ভর খাতে নীতি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এর পাশাপাশি প্রণোদনা ও নীতি সহায়তার বিষয়গুলো শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের (যেমন ন্যূনতম মজুরি, রেশন ব্যবস্থা, নারী শ্রমিকদের জন্য শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র) শর্ত সাপেক্ষে প্রদান করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বনিয়োজিত কাজের জন্য, বিশেষ করে শ্রমঘন ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদে ঋণ, ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কাঁচামালের আমদানির ওপর করছাড়, তফসিলিকরণ সুবিধা, ট্রেড লাইসেন্সের মতো বিষয়গুলোয় শর্ত শিথিল করা—এ সব বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকারের মধ্যে আনা জরুরি।
তরুণদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনেরও প্রয়োজন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ হতে হবে আধুনিক ও ভবিষ্যৎমুখী। তবে তরুণ বেকারত্বের সমস্যা দূর করতে হলে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে তরুণদের আগ্রহী করে তুলতে হবে ও এ ব্যাপারে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। এর পাশাপাশি শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে চাকরিপ্রত্যাশীদের দক্ষতার সমন্বয় করতে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমকে আধুনিক করতে হবে। সে লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষার পাঠক্রম ও পাঠ্যব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি জীবনমুখী ও আন্তব্যক্তিক দক্ষতা ও সফট স্কিল বাড়াতে হবে ও প্রযুক্তিভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
তবে শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করতে হলে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সব স্তরে, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। গ্রাম এলাকায় অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য জেলাভিত্তিক শ্রম অঞ্চলের চিন্তা করা যেতে পারে।
শ্রমবাজারে বিদ্যমান বৈষম্য কমিয়ে নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সার্বিক কর্মপরিকল্পনার পাশাপাশি দরকার সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো ও মূলধারার শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করা। এ পরিপ্রেক্ষিতে কম বয়সে বিয়ে ও সন্তানধারণের মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি পর্যায়ে কঠোর হস্তক্ষেপের বিকল্প নেই। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কর্মস্থলে বাধ্যতামূলকভাবে শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র স্থাপনের মতো পদক্ষেপের সঠিক বাস্তবায়ন, কর্মজীবী নারীদের জন্য স্বল্প খরচে আবাসন ও নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থার মতো পদক্ষেপের মাধ্যমে নারীকে মূলধারার শ্রমবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য ব্যাপক পরিসরে উদ্যোগ প্রয়োজন। এর পাশাপাশি শ্রমবাজারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীবান্ধব নীতি যেমন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে নারীদের জন্য শিথিল শর্ত ও ঋণ, সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে তাদের সংযোগ করে দেওয়া, বিশেষ প্রশিক্ষণের সুবিধা ইত্যাদির ব্যাপ্তি বাড়ানো প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে আলোচনার আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকদের শ্রমবাজার। এঁদের একটি বড় অংশ মূলত কম দক্ষতার শ্রমিক, যাঁরা মধ্যপ্রাচ্যে স্বল্প মজুরির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও উচ্চ প্রবাসন খরচ, প্রবাসে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ও নিরাপদ কাজের অভাব, মজুরি বৈষম্য, নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মালিককর্তৃক নির্যাতন—বিষয়গুলো প্রবাসীদের শ্রমবাজারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এর পাশাপাশি বৈধ পথে ডলারের বিনিময় হার কম হওয়ায় অবৈধ পথে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত হন শ্রমিকেরা। যার ফলে প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ বৈধ চ্যানেলের বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
তবে প্রবাসীদের পাঠানো আয় থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে হলে অবৈধ পথ বন্ধ করতে শক্ত নজরদারির প্রয়োজন। এর পাশাপাশি অবৈধ পথে অর্থের চালান বন্ধ করার জন্য অবৈধ অর্থের উৎস বা কাল টাকার উৎস বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই, যার জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ও ব্যবসাকেন্দ্রিক আন্ডার/ওভার ইনভয়েসিং বন্ধে কড়াকড়ি বাড়ানো প্রয়োজন। এর পাশাপাশি বৈধ পথে টাকা পাঠানো বাড়াতে হলে টাকার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হতে হবে।
প্রবাসীদের প্রবাসে সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এর পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা ও প্রবাসীদের বিদেশে কাজের চাহিদাকেন্দ্রিক দক্ষতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে নতুন গন্তব্যস্থলের ব্যবস্থা করার বিষয়টি দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপদ প্রবাসন ও টেকসই প্রবাসী আয়ের জন্য জরুরি।
সার্বিকভাবে আমাদের অভিবাসীরা স্বল্প দক্ষ ও নিম্ন উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত থাকায়, যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক অভিঘাত বা বৈশ্বিক সংকট তাদেরকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। তাই মধ্যম/দীর্ঘ মেয়াদে অভিবাসীদের স্বার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার প্রবাসীদের বিদেশের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা। এ লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের পরিধিতে আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণ ও আধুনিক দক্ষতায় প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষকের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দক্ষতায় জনশক্তিকে তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই।
সায়মা হক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক।