গত ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে যে অস্থিরতা তৈরি হয়, তার মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনা ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সব হামলাকে সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় বিবেচনায় হামলা বলে চিহ্নিত করা কঠিন। রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেও হামলা হয়েছে। জনরোষ ও ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকারও হয়েছেন অনেকে। যাঁদের ঘরবাড়ি, দোকানপাটে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে, তাঁদের মধ্যে যেমন সংখ্যালঘুরা রয়েছেন, তেমনি সাবেক শাসক দল আওয়ামী লীগের সংখ্যাগুরু মুসলমান নেতা-কর্মীরাও রয়েছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত হামলার শিকার সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৬৮। এর মধ্যে কমপক্ষে ৫০৬টি স্থাপনার মালিক আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। প্রতিবেদনে দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
এর আগে বড় ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময়। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সে বছর দেশের ২৭টি জেলায় হামলায় ১১৭টি মন্দির-পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করা হয়। ৩০১টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বসতবাড়িতে হামলা হয়। গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে নিহতের চেয়ে ২০২১ সালে নিহতের সংখ্যা বেশি ছিল, ৯ জন।
বাংলাদেশে জাতি ও ধর্মের বিবেচনায় হওয়া হামলার ঘটনাগুলোর সঠিক বিশ্লেষণ করতে হলে শুধু ৫ আগস্টের পরবর্তী ঘটনার দিকে তাকালে হবে না; বরং এ ধরনের হামলা কেন হয়, এসব হামলায় কারা লাভবান হয় এবং ভবিষ্যতে এসব হামলা কমানোর উপায় কী, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দরকার। সাম্প্রতিক গণ–অভ্যুত্থান আমাদের সামনে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে চিন্তা করতে এবং আমাদের সমাজের মধ্যে জাতীয়-ধর্মীয় পরিচয়গত ফাটলগুলো মেরামত করতে। তাই ৫ আগস্ট–পরবর্তী সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে এর রাজনৈতিক, সামাজিক ও কৌশলগত কারণ ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ জরুরি। কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের বশংবদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় অস্ত্রধারী সদস্যদের নির্বিচার গুলি ও হামলায় আহত ও নিহত হাজারো মানুষের ত্যাগ ও তিতিক্ষাদের সামনে রেখে সাম্য ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে এসব ঘটনার স্বরূপ ও প্রকৃতি বোঝাপড়া দরকার।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা কেন হয়, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও এর ফলে কে লাভবান হয় এবং কী প্রক্রিয়ায় তা প্রতিরোধ করা যায়, তা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না।
ধর্ম ও জাতিগত সন্ত্রাস ও দাঙ্গা কেন হয়, তা নিয়ে বাংলাদেশে একাডেমিক গবেষণা কম। বৈশ্বিক পরিসরে ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও নাইজেরিয়ার মাঠপর্যায়ে চালানো গবেষণা রয়েছে। এসব গবেষণায় এ ধরনের হামলার পেছনে ‘ইনস্ট্রুমেন্টাল’ কারণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ কোনো শক্তি (যেমন রাজনৈতিক দল বা কোনো ক্ষমতাশালী নেতা) এ ধরনের হামলাকে ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে ফায়দা লোটে বা সুপরিকল্পিতভাবে কোনো লাভের জন্য দাঙ্গা ও হামলাকে উৎসাহিত করে।
পল ব্রাসের (২০০৫) গবেষণায় দেখা যায়, ভারতের উগ্রপন্থী সংগঠনগুলো হিন্দু-মুসলমান বিভেদ জিইয়ে রাখতে ‘প্রাতিষ্ঠানিক দাঙ্গা ব্যবস্থা’ চালু রাখে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে এ ধরনের ধর্মীয় বিভেদ তৈরি করার প্রবণতা দেখা যায় বলে জানান স্টিভেন উইলকিনসন (২০০৪)। নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় চালানো গবেষণায় ইয়ানা ক্রাউস (২০১৮) ও ওয়ার্ড বেরেনশট (২০২০) দেখেন যে বিশেষ করে যুবকদের জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদগত ‘সন্ত্রাস ও দাঙ্গা’ তৈরি করতে সহজে ব্যবহার করেন রাজনৈতিক নেতারা। এ ধরনের জাতি-ধর্মের পরিচয়ের বিভেদ উগ্রপন্থী ও তীব্র জাতীয়তাবাদী দলগুলোর জনসমর্থন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০২২ সালে প্রকাশিত জায়নেপ বুলুটগিল ও নিরাজ প্রসাদের গবেষণায় অর্থনৈতিক বৈষম্যের সঙ্গে জাতি-ধর্মগত দাঙ্গা-হামলার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়। তাদের গবেষণা অনুযায়ী যখন সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু উভয়ই অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয় এবং একই মাত্রায় বৈষম্যের শিকার হয়, তখন তারা তাদের অর্থনৈতিক ইস্যুগুলোর দিকেই বেশি নজর দেয়, নিজেদের ধর্মীয় বা জাতিগত পার্থক্য নয়। এমন সময় রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাবশালী অশুভ শক্তিগুলো তাদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা তৈরি করে ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভেদ ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা কেন হয়, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও এর ফলে কে লাভবান হয় এবং কী প্রক্রিয়ায় তা প্রতিরোধ করা যায়, তা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। গত কয়েক দশকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং পাহাড়ে ও সমতলের জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপরে নানাবিধ হামলা লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে হিন্দুদের ওপর হামলার প্রভাব দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও পড়ে। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা এবং ভারতে মুসলমানদের ওপর হামলা উভয় দেশের রাজনীতির অন্যতম আলোচনার বিষয়। জনসমর্থন ও ভোটের রাজনীতিতে রয়েছে এর প্রভাব।
ওপরের আলোচনায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার যেসব কারণের কথা বলা হয়েছে, তা বাংলাদেশেও লক্ষ করা যায়। রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া, যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কাছে জনসমর্থন বাড়াতে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বলা, সংখ্যালঘুদের ‘রক্ষাকারী’ সেজে ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা ইত্যাদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রবণতা। এ ছাড়া জমি, দোকান ও অন্যান্য সম্পত্তির দখল নেওয়ার জন্য হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা এবং হামলার প্রেক্ষাপট তৈরির উদাহরণও রয়েছে। ২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধবিহারে হামলা ও ২০১৬ সালে নাসিরনগরের ঘটনায় দেখা যায়, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতাদের ইন্ধন ও যোগসাজশ ছিল এসব হামলায়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত হিন্দুদের ওপর কমপক্ষে ৩ হাজার ৬৭৯টি হামলার ঘটনা ঘটে।
৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া ও বিভিন্ন ব্যক্তির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিন্দুদের বাড়িঘর–মন্দিরে হামলার ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয়। পুরোনো ঘটনাকে নতুন বলে প্রচার করে, অন্য দেশের বা অন্য ঘটনার অপ্রাসঙ্গিক ভিডিও ও ছবি ব্যবহার করে ভুয়া ও অপতথ্য চালানো হয়। ডয়চে ভেলে (ইংরেজি সংস্করণ, ৭ আগস্ট ২০২৪), বাংলা আউটলুক (ইংরেজি ও বাংলা সংস্করণ, ৮ আগস্ট ২০২৪), বিবিসি (বাংলা সংস্করণ, ১১ আগস্ট ২০২৪) ও আল–জাজিরার (ইংরেজি, ৮ আগস্ট ২০২৪) অনুসন্ধানে দেখা যায়, মন্দিরে, দোকানপাটে হামলা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার অসংখ্যা মিথ্যা দাবি ও ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়। এসব বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় একদিকে যেমন প্রকৃত ঘটনাগুলোর সত্যতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে, তেমনি আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে ভুল বার্তা গিয়ে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। এক পক্ষ দাবি করে, সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো ধরনের হামলাই হয়নি, অন্য পক্ষ শত শত হিন্দু হত্যার ভুয়া দাবি সামনে নিয়ে আসে। এই দুই পক্ষের দাবিই বাংলাদেশের সহনশীল ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিপরীত মত এবং তারা ‘অস্বীকারের রাজনীতি’ ধারণ করে।
স্বৈরাচারবিরোধী গণ–অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছেন এবং প্রাণ দিয়েছেন সংখ্যালঘুরাও। ছয় বছরের ছোট্ট রিয়া গোপ বাড়ির ছাদে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে নিহত হয়। শনির আখড়ায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন দুই শিশুসন্তানের জনক ৪০ বছর বয়সী সৈকত চন্দ্র দে। ৪ আগস্ট হবিগঞ্জে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে নেমে প্রাণ দেন রিপন চন্দ্র শীল। রেখে যান আড়াই মাসের সন্তান। কমপক্ষে নয়জন হিন্দুধর্মাবলম্বী গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ হন (সমকাল, ১৩ অক্টোবর ২০২৪)। এই আত্মত্যাগ আমাদের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায়, যার ভিত্তি অসাম্প্রদায়িকতা।
জাতি-ধর্ম পরিচয়ভিত্তিক সহিংসতা কমাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর এ ধরনের সম্প্রীতি বাড়াতে সামাজিক প্রকল্প নিতে হবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত আশুতোষ ভার্শ্নের একটি গবেষণায় দেখা যায়, নাগরিক সংগঠনগুলো ট্রাস্ট নেটওয়ার্ক বা ‘বিশ্বাস সংযোগ’ তৈরি করার মাধ্যমে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তীব্রতা কমাতে সক্ষম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকেও পরিষ্কারভাবে অসাম্প্রদায়িক ও বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার কথা বলতে হবে ও সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। যে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য হাজারো মানুষ প্রাণ দিলেন, গুরুতর আহত হলেন এবং দৃষ্টিশক্তি হারালেন, তা সফল হবে তখনই যখন সব ধরনের বিশ্বাস ও মতের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত হবে।
* সাইমুম পারভেজ : ডয়চে ভেলে একাডেমির রাজনৈতিক যোগাযোগবিষয়ক প্রভাষক