ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর জন-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী দেশ এখন সংস্কারের পথে যাত্রা শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচনব্যবস্থা, সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। দেশের অগ্রগতির জন্য স্থানীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলেও প্রথম দিকে এ বিষয়ে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তবে আশার কথা, গত ৩১ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার একজন উপদেষ্টা স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠনেরও ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ। কেননা, আমরা যদি উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে চাই, তবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল সংবিধানে কার্যকর ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরের সার্বিক কর্মকাণ্ড জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে পরিচালনাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রশাসনিক কার্যক্রম, জনশৃঙ্খলা রক্ষা, জনসেবা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, কর আরোপ এবং বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু সাংবিধানিক আকাঙ্ক্ষার আলোকে আমাদের দেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আইনসমূহ প্রণীত না হওয়ায় শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম নীতি হলো ‘যেখানে সমস্যা, সেখানেই সমাধান’। তা সম্ভব না হলে তার ওপরের স্তরে যাওয়া। এভাবেই সীমিতসংখ্যক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত করা। কেননা, রাষ্ট্রের সব সমস্যা কেন্দ্রীয় সরকারের একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। বিকেন্দ্রীকরণের এই নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজন ক্ষমতা, দায়িত্ব ও সম্পদে শক্তিশালী করাসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক ও জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা; যা আজও কার্যকর হয়নি। ফলে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই আমাদের দেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন ছিল নির্দলীয়। ২০১৫ সালে আইনে পরিবর্তন এনে রাজনৈতিক দলভিত্তিক নির্বাচনের বিধান করা হয়। এতে বিরাজমান দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব যেমন গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
আইনগতভাবে প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক হওয়ার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকাংশেই মেয়র বা চেয়ারম্যাননির্ভর। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হয় পদভিত্তিক। ভোটাররা ভোট দিয়ে মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর বা সদস্য নির্বাচিত করেন। ফলে জনপ্রতিনিধিদের আচরণেও ঊর্ধ্বতন ও অধস্তনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময়েও অপেক্ষাকৃত প্রভাবশালীরা মেয়র বা চেয়ারম্যান পদে এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বলেরা কাউন্সিলর বা মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় স্থানীয় সরকারে সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন। অর্থাৎ প্রথমে সবাই কাউন্সিলর বা মেম্বার হবেন এবং পরে নির্বাচিতরা বসে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচন করবেন। এই পদ্ধতির নির্বাচন একদিকে যেমন প্রার্থীদের গুণগত মান উন্নত করবে, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে গণতন্ত্র চর্চার দ্বার উন্মুক্ত করবে। কেননা তখন মেয়র বা চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদেরও কাউন্সিলর বা সদস্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এ ছাড়া জেলা পরিষদ নির্বাচন ‘মৌলিক’ গণতন্ত্রের আদলে না করে সাধারণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে আয়োজন করতে হবে।
বর্তমানে নারীদের জন্য যে ধরনের আসন সংরক্ষণের পদ্ধতি রয়েছে, তাতে একই এলাকায় সাধারণ আসনের কাউন্সিলর বা সদস্যদের সঙ্গে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর বা সদস্যদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দ্বৈততা সৃষ্টি হয়। এই পদ্ধতি পরিবর্তন করে ঘূর্ণমান পদ্ধতিতে আসন সংরক্ষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মোট ওয়ার্ডের এক-তৃতীয়াংশ নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং ওই ওয়ার্ডগুলোতে শুধু নারীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অন্য ওয়ার্ডগুলো নারী-পুরুষ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। পরবর্তী নির্বাচনে আগের সংরক্ষিত ওয়ার্ডগুলো উন্মুক্ত করে দিয়ে অন্য এক-তৃতীয়াংশ ওয়ার্ড নারীদের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। এভাবেই আসন সংরক্ষণের পদ্ধতি ঘূর্ণমান থাকবে। এতে একদিকে যেমন ওয়ার্ড পর্যায়ে দায়িত্ব পালনে দ্বৈততা থাকবে না, পাশাপাশি নারী জনপ্রতিনিধির সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন ছিল নির্দলীয়। ২০১৫ সালে আইনে পরিবর্তন এনে রাজনৈতিক দলভিত্তিক নির্বাচনের বিধান করা হয়। এতে বিরাজমান দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব যেমন গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়; পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কবহির্ভূত জনকল্যাণে নিবেদিত নাগরিকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ সংকুচিত হয়ে পড়ে। এসব কারণেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হওয়াই শ্রেয়।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতার পরিপন্থী। আইনানুযায়ী সংসদ সদস্যরা বর্তমানে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা। আইনের এই সুযোগে সংসদ সদস্যরা ইউনিয়ন পরিষদসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ওপরে খবরদারি করেন। স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে সংসদ সদস্যদের এই হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ করতে হবে। উল্লেখ্য, জেলামন্ত্রীর পদ সৃষ্টিকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা এক মামলার রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবির স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সংসদ সদস্যদের জড়িত হওয়াকে ক্ষমতা পৃথক্করণ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিবেচনায় একে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন [আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বনাম বাংলাদেশ, ১৬ বিএলটি (এইচসিডি) (২০০৮)]।
উপজেলা পরিষদের আরেকটি সমস্যা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দ্বৈত শাসন। এ ক্ষেত্রে পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু বিভাগ উপজেলা পরিষদের হাতে ন্যস্ত করার কথা থাকেলও তা অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি। এই দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটিয়ে পরিষদে জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বর্তমানে প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ওয়ার্ড ৯টি করে। কিন্তু একটি ইউনিয়নের সঙ্গে আরেকটি ইউনিয়নের এবং একটি পৌরসভার সঙ্গে আরেকটি পৌরসভার জনসংখ্যার ব্যবধান অনেক। সেবার মানোন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠান দুটির ওয়ার্ড জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারণ এবং প্রয়োজনে ৯টির অধিক ওয়ার্ড নিয়ে ইউনিয়ন বা পৌরসভা গঠনের বিধান করা উচিত। সরকারি বরাদ্দ নির্ধারিত হবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে।
স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমে জন–অংশগ্রহণের একটি অনন্য উদ্যোগ ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সভা; যা এখন চলছে অনেকটা দায়সারাভাবে। এগুলোকে এমনভাবে কার্যকর করতে হবে, যাতে জন–অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় ওয়ার্ডের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, সমস্যা সমাধানের অগ্রাধিকার নির্ণয়, বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অংশীজনদের তালিকা তৈরি, পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি যেন যথাযথভাবে হয়। ওয়ার্ডসভার বিধানটি পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন আইনেও যুক্ত করা যেতে পারে। পাশাপাশি উন্মুক্ত বাজেট অধিবেশন ও স্থায়ী কমিটিগুলোকে সক্রিয় করার উদ্যোগ সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে গ্রহণ করা উচিত।
নির্বাচন আয়োজন একটি ব্যয়বহুল আনুষ্ঠানিকতা। সব সময়ই নির্বাচন কমিশনকে ব্যস্ত থাকতে হয় এ নিয়ে। ব্যয়, সময় সাশ্রয়সহ জনকল্যাণে আত্মনিবেদনে আগ্রহী বিপুলসংখ্যক মানুষকে জনপ্রতিনিধি বাছাইপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন একই সময়ে আয়োজন করা যেতে পারে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ায় একই ব্যক্তি ঘুরেফিরে সেগুলোতে প্রার্থী হয়েছে।
জনকল্যাণে কার্যকর অবদান রাখার জন্য ক্ষমতা ও দায়িত্বের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদের প্রয়োজন রয়েছে। সম্পদের এই সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য ‘স্থানীয় সরকারের তহবিল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে সংগ্রহ করতে হবে’—এই বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় বাজেটের একটি অংশ স্থানীয় সরকারের নামে বরাদ্দ করতে হবে। পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরও আয়ের উৎস সৃষ্টি করতে হবে, প্রয়োজনীয় জনবল দিতে হবে এবং জনপ্রতিনিধিদের ভাতা সম্মানজনক পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে।
পরিশেষে আমি মনে করি, সংস্কারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালীকরণের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেওয়ায় দেশে শক্তিশালী ও কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার এক অপূর্ব সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে; যা নিঃসন্দেহে আমাদের উন্নয়নের গতিকে ত্বরাণ্বিত করবে।
* দিলীপ কুমার সরকার : সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী