বাংলার মুখ

‘বাংলার ম্যানচেস্টারে’ আলোর স্কুল

শেরেবাংলাসহ অনেক বিখ্যাত মানুষ বরিশাল জিলা স্কুলের শিক্ষার্থী
ছবি: মো. সাইয়ান

বরিশালের কথা উঠলেই চোখে ভেসে ওঠে শস্য-শ্যামল ও নদীবিধৌত এক জনপদের ছবি। স্কটল্যান্ডের নাগরিক হেনরি বেভারেজ ছিলেন তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার (বর্তমানে উপজেলা) কালেক্টর। বরিশালকে তখন যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তিনি। ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ গ্রন্থে তিনি বাংলার এই ম্যানচেস্টারের নদী-প্রকৃতির প্রশংসা করেন। শস্য উৎপাদনের বিস্ময়কর জায়গা অভিহিত করে লেখেন, ‘পরিখাবেষ্টিত গোলাবাড়িসংবলিত পল্লিবাড়িগুলো নানা ফলদ বৃক্ষে ঢাকা। এখানকার অধিবাসীরা সচ্ছল জীবন যাপন করে। তাই তারা দেশের অন্য অধিবাসীদের কাছে হিংসার পাত্র।’ 

সেই বরিশালেই এখন থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল আধুনিক শিক্ষার। আর তার সূতিকাগার ছিল বরিশাল জিলা স্কুল। এই স্কুল সম্পর্কে বেভারেজ লেখেন, ‘এই অঞ্চলের প্রতিটি মহকুমা সদরে একটি করে ইংলিশ স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে বরিশালের ইংলিশ স্কুলটি শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার।’ 

ইতিহাস বলছে, ১৮২৯ সালে ‘বরিশাল ইংলিশ স্কুল’ নামে যাত্রা শুরু করে বরিশাল জিলা স্কুল। শুরুতে এটি মিশনারিদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডব্লিউ এন গ্যারেট স্কুল খোলার লক্ষ্যে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন। পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুর মিশনের তত্ত্বাবধানে ১৮২৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর মাত্র ৮ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করে বরিশাল ইংলিশ স্কুল। ওই বছরেই ছাত্রসংখ্যা বেড়ে হয় ২৭। প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন জন স্মিথ। ১৮৩৩ সালের অক্টোবরে মিশনের কাজে বরিশাল থেকে চলে যান স্মিথ। তাঁর জায়গায় আসেন সিলবেস্টার ব্যারিরো। তাঁর সময়ে স্কুলের অনেক উন্নতি হয়। ১৮৪৬ সালে তিনিও স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে পুরোপুরি মিশনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু বছরখানেক পরে স্কুলের টানে পুনরায় ফিরে আসেন। ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। 

১৮৫৩ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত স্কুলের ব্যয়ভার বহন করে ব্রিটিশ সরকার। তখন থেকে নাম হয় ‘বরিশাল জিলা স্কুল’। স্কুল উন্নয়নে সায়েস্তাবাদের জমিদার সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, খানবাহাদুর হেমায়েত উদ্দীনের অবদান অনস্বীকার্য। পরবর্তী সময়ে মার্কিন বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানেও এর প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত নানাবিধ পরিবর্তন হয়েছে। 

শেরেবাংলা, সরদারের স্কুল

অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৮৮৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এই স্কুল থেকেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি যখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন, তখন ১৯৩৯ সালের ৬ আগস্ট জিলা স্কুল পরিদর্শন করেন। এ সময় তাঁর উদ্যোগেই স্কুল ভবন সম্প্রসারণ করা হয়। তিনি পাশের একটি সরকারি পতিত জমিকে স্কুলের খেলার মাঠ হিসেবে উপহার দেন। 

এ ছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী, অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পিকার আবদুল জব্বার খান, বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধূরী, বীর বিক্রম হাফিজ উদ্দিন আহম্মদের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা বরিশাল জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব গুহের জন্ম কলকাতায় হলেও বাংলাদেশের বরিশাল ও রংপুরে কেটেছে তাঁর শৈশব। তিনিও এই স্কুলেরই ছাত্র। 

বিদ্যালয়টির অতীত গৌরবের ধারাবাহিকতা এখনো ধরে রেখেছে। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা প্রায় ২ হাজার ১০০। প্রতিবছর বিদ্যালয়টি থেকে গড়ে সাড়ে ৩০০ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাসের হার শতভাগ। এদের মধ্যে গড়ে ২২০ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। বিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, ২০২১ সালে ৩৩০ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২৬৫ জন। ৪৬ জন শিক্ষক আছেন। 

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও ভালো ফল ধরে রাখতে আমরা নিরলসভাবে চেষ্টা করে চলেছি। তবে অবকাঠামোগত সমস্যা আছে। কম্পিউটার ল্যাব না থাকায় শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে হাতেকলমে শিক্ষা নিতে পারছে না।’ 

লেখক:প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল