জাহাজভাঙা

আটকে পড়া জাহাজ থেকে শিল্প

সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা কারখানায় কাটার জন্য আনা হয়েছে একটি জাহাজ
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্পের শুরুটা নাটকীয়। সিনেমার মতো। পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ নয়। এক দুর্যোগ এমন একটা শিল্পের দ্বার খুলেছিল। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূলে প্রচণ্ড গতিতে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়। ওই ঝড়ে সীতাকুণ্ডের শীতলপুর উপকূলে আটকা পড়ে গ্রিক জাহাজ এমভি আলপাইন।এই জাহাজ আর সাগরে ভাসানো সম্ভব হয়নি।পরিত্যক্ত অবস্থায় উপকূলেই ছিল এটি।

এই জাহাজ দেখতে স্থানীয় লোকজনের ভিড় হতো প্রতিদিন। কেউ কেউ জাহাজে ওঠার চেষ্টাও করতেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এ এক বিস্ময়। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম স্টিল হাউস কর্তৃপক্ষ জাহাজটি কিনে নেয়। এরপর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে জাহাজটি ভেঙে স্ক্র্যাপ লোহা সংগ্রহ করা হয়। এভাবেই জাহাজভাঙা শব্দটির সঙ্গে আস্তে আস্তে পরিচয় হয়।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানি একটি জাহাজের লোহাও পরে স্ক্র্যাপ জাহাজ হিসেবে বিক্রি হয়। কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান জাহাজটি কিনে নিয়ে ভেঙেছিল। ব্যাপারটা লাভজনক হয়েছিল নিশ্চয়ই। শুরু হয়ে গেল জাহাজভাঙার কারবার। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে রমরমা একটা ব্যবসায় পরিণত হয় সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্প। জাহাজভাঙা কারখানা এলাকার মানুষের আয়–উপার্জন বাড়িয়ে দেয়। এক জাহাজভাঙা কারখানায় হাজার রকমের কাজ, আবার হরেক রকম পণ্যের কারবারও রয়েছে। তাই হাজার হাজার মানুষের রুটিরুজির ব্যবস্থা ওখানেই হয়।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৪৭টি জাহাজ আমদানি হয়েছে। এতে লোহার পরিমাণ ছিল প্রায় দশ লাখ টন। জাহাজভাঙা শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, জাহাজ আমদানি করে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৫ থেকে ৬০টি। এই জাহাজের নানা পণ্য বেচাকেনার সঙ্গে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান জড়িত। জাহাজভাঙা শিল্পের বাইরে ব্যবহৃত পণ্য বেচাকেনায় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৬০ সালে একটি জাহাজ আটকা পড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে জাহাজভাঙার কারবার শুরু হয়। জমজমাট একটা ব্যবসা ছিল। কিন্তু এখন ব্যবসা অনেকটাই মন্দা যাচ্ছে।

হরেক রকম পণ্য

জাহাজের যত লোহা আছে, তার প্রায় সবই পুনর্ব্যবহার করা যায়। ক্ষতিকর বর্জ্য ছাড়া জাহাজের আর কোনো কিছুই যেন ফেলনা নয়। একটি জাহাজে যেমন বড় আকারের রসুইঘর থাকে, তেমনি থাকে নাবিকদের আবাসন, চিকিৎসা, স্টেশনারি। আবার জাহাজ চালানোর জন্য থাকে জেনারেটর ও যন্ত্রপাতি। আলপিন থেকে শুরু করে নাটবল্টু, রান্নাঘরের জিনিস থেকে শিল্পকারখানার কাঁচামাল—এমন হাজারো পণ্য থাকে পুরোনো জাহাজে।

নিলামে যাঁরা পণ্য পান, তাঁরা বাইরে ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন। হাতবদল হয়ে এই পণ্য চলে যায় ব্যবহারকারীদের হাতে। জাহাজভাঙা পণ্য বেচাকেনা হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি স্থানে। চট্টগ্রামের বাঁশবাড়িয়া থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত মহাসড়কের আশপাশে অসংখ্য দোকান রয়েছে, যেগুলোতে জাহাজভাঙা পণ্য বিক্রি হয়। এ ছাড়া পাহাড়তলী সিডিএ মার্কেট, সাগরিকা, পশ্চিম মাদারবাড়ী, কদমতলী ও মুরাদপুর এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন পণ্য বিক্রি হয়। ঢাকার ধোলাইখাল ও সদরঘাটেও বিক্রি হয় চট্টগ্রামের জাহাজভাঙা পণ্য।

জাহাজে শিল্পকারখানার কাঁচামাল থাকে অনেক। রিরোলিং মিলের কাঁচামাল ইস্পাত তার মধ্যে অন্যতম। বড় পাইপ, যন্ত্রপাতিসহ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, আসবাব—কী থাকে না এখানে। জাহাজের বড়-ছোট জেনারেটর, বৈদ্যুতিক তার, তৈজসপত্র, শোপিস, ব্যায়ামের সরঞ্জাম, এয়ারকন্ডিশনার, বৈদ্যুতিক পাখা, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, সাউন্ডবক্স, প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিন, কম্পিউটার, টেলিভিশন ইত্যাদিও মেলে একটি জাহাজে। এ ছাড়া রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে জাহাজের সবচেয়ে দামি অংশ প্রপেলার। বড় জাহাজের প্রপেলার বিক্রি হয় কমবেশি পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকায়। তামা, পিতল, মরিচারোধী ইস্পাতের সরঞ্জামের মতো অনেক পণ্য রপ্তানিও হয়।

রমরমা ব্যাপারটা নেই

বৈশ্বিক সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা, পরিবেশদূষণসহ নানা কারণে সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্পের আগের সেই রমরমা ভাব নেই। একসময় এখানে কমবেশি দেড় শতাধিক জাহাজভাঙা কারখানা ছিল। সীতাকুণ্ড উপকূলের সলিমপুর থেকে কুমিরা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল এই শিল্পের কাজকারবার। এখন সব মিলিয়ে ৩৫টির মতো ইয়ার্ড চলছে বলে বিএসবিআরএ সূত্র জানায়। সংগঠনটির সচিব নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এখন নতুন করে জাহাজ আসেনি। এক মাস আগে যেসব জাহাজ এসেছিল, সেগুলো কাটা হচ্ছে।’

সংগঠন সূত্র জানায়, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশ বিশ্বে জাহাজভাঙা শিল্পে প্রথম অবস্থানে ছিল। ২০২০ সালে করোনা অতিমারির সময়ও বাংলাদেশ একাই বিশ্বের ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ রিসাইকেল করেছে। ২০২১ সালেও জাহাজভাঙা শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম ছিল।

বিশ্বে প্রতিবছর কমবেশি ৬০০–এর বেশি জাহাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এসব জাহাজের একটা বড় অংশ বাংলাদেশে রিসাইকেল হয়ে থাকে। বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি জাহাজ রিসাইকেল হয় বাল্ক ক্যারিয়ার। এরপর কনটেইনার শিপ ও অয়েল ট্যাংকার।

ঝুঁকি ও দূষণে দুষ্ট: জাহাজভাঙা শিল্প আবার সমালোচিত শিল্প খাতও বটে। ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিবেশবিধ্বংসী শিল্প হিসেবে এই শিল্প বর্তমানে লাল শ্রেণিভুক্ত। নানা সময়ে এই জাহাজভাঙা শিল্পের বিরুদ্ধে শ্রমশোষণ এবং পরিবেশদূষণের অভিযোগ ওঠে। হতাহতের ঘটনাও নেহাত কম নয় এই শিল্পে। নানা আইন ও নিয়মকানুনের মাধ্যমে এই শিল্পে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা চলছে অনেক বছর ধরে। পরিবেশবাদীদের দাবির মুখে দূষণ ও ঝুঁকিমুক্ত শিল্প গড়ার অঙ্গীকার করে সরকার।

জাহাজভাঙা শিল্পের জন্য আন্তর্জাতিক বিধি বাসেল কনভেনশনস ১৯৮৯, হংকং কনভেনশন ২০০৯, আইএলও’র পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কনভেনশন ১৯৮১, পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত আইএলও গাইডলাইনস ২০০১ এবং আইএমও গাইডলাইনস ২০১২ প্রযোজ্য। এ ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ের ১২টি আইন ও প্রবিধান এ শিল্পের জন্য প্রযোজ্য। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জাহাজভাঙা শিল্পকে সবুজ শিল্প বা গ্রিন ইয়ার্ড হিসেবে গড়ে তোলার তোড়জোড় চলছে কয়েক বছর ধরে। এখন পর্যন্ত চারটি প্রতিষ্ঠান তাদের ইয়ার্ড গ্রিন করেছে বলে জানান বিএসবিআরএ-এর সচিব নাজমুল ইসলাম। আরও অন্তত ১৫টি ইয়ার্ড গ্রিন করার কাজে হাত দিয়েছে বলে তিনি জানান। পাঁচ বছর আগে এই যাত্রায় প্রথম নাম লেখায় পিএইচপি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। শুরু হয় সবুজ শিল্প করার উদ্যোগ।