স্মৃতির আয়নায় আমার একাত্তর

প্রথম আলোর বয়স মাত্র ২৫ বছর, কিন্তু এর অর্জন অনন্য। প্রথম আলো তার স্বপ্নের পথে এগোতে এগোতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে অভূতপূর্ব কিছু মাইলফলক স্থাপন করেছে। সাহসী সাংবাদিকতা, উদ্ভাবনী পরিকল্পনা, দেশ ও বিদেশের অগ্রগণ্য মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল এর শক্তি। প্রথম আলোর ২৫ বছরের নির্বাচিত ও সংক্ষেপিত বিষয়বস্তু থেকে পাওয়া যাবে এর স্বতন্ত্র পথরেখার নিশানা।

সরদার ফজলুল করিম

পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর হাতে বন্দী ঢাকার অসহায় মানুষ আমরা।

ওরা ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিত আক্রমণে আমাদের ঘেরাও করে ফেলল। ট্যাংক, কামান ও মেশিনগানে ওরা ঢাকার বুকে সে রাতে রাজারবাগ পুলিশ ঘাঁটিতে, পিলখানায়, ইকবাল হল (জহুরুল হক হল) আর জগন্নাথ হলে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করল।

পুরো ২৬ তারিখ ওরা সান্ধ্য আইন জারি রেখে চালাল হত্যালীলা। ২৭ মার্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন তুলে নিতেই হাজারো নয়, লাখো অসহায় মানুষ কাপড়চোপড়ের একটি করে পুটুলি নিয়ে অবোধ শিশুদের কোলে, কাঁখে, মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল ঢাকা শহর ছাড়ার জন্য। সন্ধ্যা হয় হয়, তবু অসহায় ভয়ার্ত মানুষের বিরাম নেই। বুদ্ধি দিয়ে খুঁজে পেলাম না কোথায় যাবে ওরা? কেমন করেই–বা যাবে? হানাদার বাহিনী বিনা অজুহাতে গুলি করছে, আগুন দিচ্ছে।

২৬ তারিখ বিকেলে মতিঝিল কলোনির বাসা থেকে দেখলাম, দক্ষিণ দিকে ঊর্ধ্বগতির কালো ধোয়ার কুণ্ডলীতে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। সেদিন বুঝিনি। পরে শুনেছি, সেদিন ওরা ইত্তেফাককে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করেছে।...

আমি জানি, ইন্ডিয়া চলে যাওয়াই ভালো। তাতে আমার নিজের জীবনের নিরাপত্তা আসবে। তখন আর দিন-রাতের চব্বিশ ঘণ্টার প্রতি মিনিটে, প্রতি সেকেন্ডে মৃত্যুর আতঙ্ক থাকবে না। কিন্তু অবোধ শিশু আর স্ত্রী নিয়ে আমার সংসার। সংসার নয়, ছোট্ট পাখির বাসা। আমার মতোই হাজার হাজার পরিবার অসহায়। আমি কোথায় যাব আমার পাখির বাসাকে বর্বরের হাতে ছেড়ে দিয়ে। না, আমি তা পারব না। প্রতি রাতে বাসার দুয়ারে জিপের শব্দে শিশুপুত্র আতঙ্কে আমাকে জড়িয়ে ধরে: আব্বা, এই জিপ এসে থেমেছে। আমি জানি, ওই জিপ একদিন আমার জন্যই আসবে। আসুক। এসে আমাকে টেনে নিক। গুলি করে মেরে ফেলুক। তবু যেন পাখির ছানার মতো আমার নিরীহ সন্তানদের ওপর অত্যাচার না করে। শুধু আজ নয়, করুণ হাসি ফুটেছে নিজেরই মুখে সেদিনও, এই নির্বোধ কামনায় কত শিশুকে ওরা খুন করেছে মা-বাবার সামনে, সে কাহিনি কি কান থেকে কানে ছুটতে ছুটতে সেদিন আমার কানেও পৌঁছায়নি? তবু আমি ছেড়ে যেতে পারিনি। আমার অসহায় স্ত্রী আর সন্তানদের আরও অসহায় করে।...

৭ সেপ্টেম্বর একাডেমিতে গিয়ে বসতেই সাদা পোশাক পরা দুটো পাঞ্জাবি পাষণ্ড এসে ঘরে ঢুকে আমার দুপাশে দাঁড়িয়ে বলল, আর ইউ সরদার ফজলুল করিম। আমি বললাম, হ্যাঁ। ওরা বলল, ইউ আর টেকন ইনটু কাস্টডি—তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো; বলেই প্রায় জোর করে অপেক্ষমাণ জিপে আমাকে তুলে নিয়ে বেদনাহত বন্ধুদের চোখের সামনে দিয়ে মুহূর্তে জিপটা বেরিয়ে এল বহু বছরের স্মৃতিবিজড়িত বাংলা একাডেমির অফিস থেকে।

জিপের মধ্যে শূন্য চোখে বসে বসে নিজের মনের দিকে তাকাই। দেখি মন বলছে, বিদেহী আত্মার কথা তো মিথ্যা হলো না। ভূত-ভবিষ্যতের কথা হয়তো জানে এই বিদেহী আত্মারা। তাহলে মিথ্যা হবে না সেই বাণীও—স্বাধীন হবে বাংলাদেশ। আমার মৃত্যুর আশঙ্কা কিংবা মৃত্যু সে তো আজ লাখো ঘটনার একটিমাত্র ঘটনা। কিন্তু ইতিহাসের চাকা কি বর্বর দস্যুর দল আমাদের হত্যা করে স্তব্ধ করতে পারবে? কোনো দস্যুর দলই কি পেরেছে কোনো দিন?...

জিপটা এতক্ষণে শহরের রাস্তা ঘুরে ক্যান্টনমেন্টের পথ ধরেছে।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮ (সংক্ষেপিত)