একটা গণ-অভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লব যেমন অনেক নতুন ধারণা হাজির করে, আবার অনেকগুলো পুরোনো এবং গেড়ে বসা ধারণা বা চিন্তা অপ্রাসঙ্গিক করে দেয়। এসব ধারণা কিংবা চিন্তা বহনকারী ব্যক্তিরাও স্বাভাবিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শেষ দিকে জনাকয় চলচ্চিত্রশিল্পী, নির্মাতার কিছু বার্তা ভাইরাল হলে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। তাঁরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ‘গরম জল’ ঢেলে দিতে বলেছেন, পুলিশকে আরও কঠোর হতে বলেছেন ইত্যাদি। আশ্চর্যের কিছু নেই। তাঁরা তাঁদের দাসত্বের দায় শোধ করেছেন। স্বাভাবিকভাবে এই নতুন সময়ে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন। তাঁদের আদর্শিক মৃত্যু ঘটেছে। তাঁরা আর আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পারবেন না।
এটা বলছি রাজনৈতিক বিচারের জায়গা থেকে। তাঁরা রাজনৈতিক দায় মেটাতে পারেননি, তাই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন নতুন সময়ে। কিন্তু নান্দনিক দায় অত সহজে শোধ হওয়ার নয়। রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক ছিলাম বলেই নান্দনিকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠব, অতটা স্বয়ংক্রিয় নয় বিষয়টা। এমনকি ফ্যাসিস্টদের ‘ফুট-সোলজার’ না হয়েও আপনি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারেন। আবার নতুন রাজনীতির ফ্রন্টলাইনার হলেই যে আপনার নান্দনিক গ্রহণযোগ্যতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে যাবে, এমনটাও নয়।
গত শতাব্দীর রুশ বিপ্লব থেকে এমন ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। জমিদার তলস্তয় কোনোভাবেই বিপ্লবের পক্ষের লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন সেই শ্রেণির প্রতিনিধি, যাঁদের বিরুদ্ধে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। তবু তাঁকে বিচার করতে গিয়ে লেনিন বলেছিলেন, ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ’। আবার রুশ বিপ্লবের ফ্রন্টলাইনার কবি মায়াকোভস্কির বিপ্লব-পরবর্তী লেখাজোখা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা আছে। বিপ্লবের স্পিরিটের বিপরীতে থাকা অনেক লেখক যথা পাস্তেরনাক কিংবা ইয়েভতুশেঙ্কো অমরত্বের স্বাদ পেয়েছেন। আবার বিপ্লবের পক্ষে থাকা অনেকেই হারিয়ে গেছেন।
বিপ্লবোত্তর সময়ের শিল্পকলার কাজটা বহুমাত্রায় জটিল হয়ে পড়ে। কারণ, শিল্পীকে তখন একই সঙ্গে বিপ্লব ও শিল্পকে সমুন্নত রাখতে হয়। বিপ্লবকে সমুন্নত রাখার কাজটা তাঁকে করতে হয় প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে। আবার শিল্পকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে তাঁর চিন্তা কখনো কখনো বিপ্লবের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।
বিপ্লবোত্তর সময়ের শিল্পকলার কাজটা বহুমাত্রায় জটিল হয়ে পড়ে। কারণ, শিল্পীকে তখন একই সঙ্গে বিপ্লব ও শিল্পকে সমুন্নত রাখতে হয়। বিপ্লবকে সমুন্নত রাখার কাজটা তাঁকে করতে হয় প্রোপাগান্ডা মেশিনে পরিণত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে।
আমাদের কবিতার কথা যদি ধরেন—মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদী বয়ানের প্রথম শহীদ আমাদের শামসুর রাহমান। তিনি সরল বিশ্বাসে সে সময়ের সবচেয়ে প্রগতিশীল বয়ানের চর্চা করে গেছেন তাঁর কবিতায়। তুলনায় আল মাহমুদের পথপরিক্রমা ছিল জটিল। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহাবয়ানকেই সংহত করেছেন। তারপর ধীরে ধীরে সরে গেছেন। তখন বলা হয়েছে, আল মাহমুদ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেছেন। যখন আফগানিস্তানে মুজাহিদদের উত্থানকে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মৌলবাদের উত্থান বলে ধরা হতো, সে সময়ে আল মাহমুদ মুজাহিদদের বীরত্বগাথা রচনা করলেন কবিতায়। এভাবে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রকল্পে একজন মৌলবাদী হিসেবে শনাক্ত হয়ে রইলেন। বেশির ভাগ সাহিত্য পাতার প্রথম পাতা থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হলো। কিন্তু আল মাহমুদ টিকে রইলেন।
আমাদের সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায়ের নাম মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের একক সম্পত্তি কখনোই ছিল না। কিন্তু এটাকে ব্যাপকভাবে আওয়ামীকরণ করা হয়েছে। বিগত এক দশকে মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামীকরণের মাত্রা ছিল ভয়াবহ। গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, সিনেমায় সবখানেই এর নজির মেলে। আপনি উপন্যাস লিখছেন, পুরস্কার পাবেন কি না, তা নির্ধারণ করবে আপনার উপন্যাসে থাকা মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানটি। সিনেমা বানাবেন, চলচ্চিত্র অনুদান পাবেন কি না, সেটা নির্ধারণ করবে আপনি কার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল লেখকের লেখা হলে আপনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু আওয়ামী বয়ান থেকে বাদ পড়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব। মুজিবময় এই ইতিহাসে ভাসানীর জায়গা নেই, সোহরাওয়ার্দীকে কেউ চেনে না, শেরেবাংলাকেও না।
এভাবে কি আওয়ামী লীগ নিজেদের জন্য খুব শক্তিশালী সংস্কৃতি-বয়ান বানিয়ে যেতে পেরেছে? বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে, কিন্তু বয়ান দাঁড়ায়নি। শেখ মুজিবের জীবনীভিত্তিক বড় বাজেটের ছবি বানানোর জন্য শ্যাম বেনেগালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ছবিটি কোনো আবেদন তৈরি করতে পারেনি। স্কুলে স্কুলে বাধ্যতামূলকভাবে ছবিটি দেখানো হয়েছে। কয়েকটা স্কুল থেকে শুনলাম, ছবিতে যখন পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ডটি ঘটে, তখন মিলনায়তনে কোনো শোকের আবহ তৈরি হয়নি। বরং ঠাট্টা–মশকরা এবং অনভিপ্রেত হুল্লোড়ের ঘটনা ঘটেছে। এটি তো পরিষ্কার প্রত্যাখ্যান। ফ্যাসিজমের কালচারাল বয়ান তৈরির ধান্দাবাজিকে প্রত্যাখ্যান। এক টাকার শুভ আর কোটি টাকার শ্যামকে প্রত্যাখ্যান। সেই প্রত্যাখ্যানের তিক্ত স্বাদ শেখ মুজিবকে দ্বিতীয়বারের মতো পেতে হলো।
এমন না যে ফ্যাসিবাদ কিংবা আগ্রাসনের সাংস্কৃতিক শিল্পভাষ্য তৈরি করলে সেটা আবেদনময় হবে না। জেমস বন্ডের মুভিগুলো স্নায়ুযুদ্ধে মার্কিন শক্তির তাঁবেদারি করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো শিল্পসফল ও ব্যবসাসফল ছিল। ভারতে হিন্দুত্ববাদকে ভালোই সেবা দিচ্ছে সিনেমা! কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ব্যর্থ হয়ে গেল। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ছবি মানেই বিনোদনহীন এবং প্রশ্নহীন আদর্শের প্রচার। সেই প্রচারে কোনো শৈল্পিক চাতুর্য নেই, কেবল একটা প্রায় ধর্মীয় অনুশাসনের মতো ব্যাপার আছে।
নতুন যে প্রজন্ম আসছে, যাদের আপনারা বলেন জেন-জি, তারাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বয়ান প্রত্যাখ্যান করল। এই ছবি আদতে এদের উদ্দেশ্য করেই বানানো হয়েছিল, আমাদের জন্য নয়। আমরা তো প্রায় জন্ম থেকেই এই বয়ানের ভোক্তা। আওয়ামী লীগের রাজনীতির অংশ না হয়েও অনেকে এই বয়ান সমুন্নত রেখে চলেছেন। এটাই ছিল ফ্যাসিস্ট রেজিম তৈরি হওয়ার সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা।
এভাবেই হেজিমনি তৈরি হয়েছে ৫০ বছর ধরে। এই হেজিমনি সমাজে এখনো গেড়ে বসে আছে। ফ্যাসিজমের শারীরিক পতন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কালচারাল ফ্যাসিজমকে শনাক্ত করার এবং উপড়ে ফেলার লড়াই কেবল শুরু হয়েছে। এটা কোনো ব্যক্তিকে হামলা-মামলা করার ব্যাপার নয়। প্রবণতাগুলোকে চিনতে পারতে হবে। আওয়ামী বয়ানের বাইরে যে ব্যাপক বিস্তৃত মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ অর্জনের লড়াই, সেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জায়গা কোথায়, তার সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের মন ও যাপনের মোকাবেলা কীভাবে হবে, সমাজতন্ত্রের লড়াই কোথায় থেমে গেল, ইনসাফের আর ন্যায়ভিত্তিক সমাজ তৈরির মোমেন্টাম কীভাবে শুরু হবে? এসবই জরুরি ভাবনার জায়গা।
নতুন সময়কেও ঠিকঠাক চিনতে পারার ব্যাপার আছে। আপনি সাহিত্য করবেন, মতাদর্শের আলখাল্লা থেকে ঠিকমতো বের হতে পেরেছেন তো? ফিল্ম বানাবেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই যে অযুত পরিমাণ বিদ্রোহ আর নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলোর ফুটেজ ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই দৃশ্যগুলোর ওপর আপনি কীভাবে নান্দনিক সুবিচার করবেন? যে গানগুলো আপনি শুনেছেন এই অভূতপূর্ব সময়ে, কীভাবে তার ক্যাটাগরাইজেশন করবেন? ধনধান্য পুষ্পভরা থেকে কুন ফায়া কুন হয়ে আওয়াজ উডা পর্যন্ত যে সাংগীতিক বিস্তার—এটাই এই বিপ্লবের সাউন্ডস্কেপ। এই সাউন্ডস্কেপের ওপর আছড়ে পড়ছে সাউন্ড গ্রেনেড, মাথার ওপর নিয়ত চক্কর মারছে হেলিকপ্টার। শিল্পী হিসেবে আপনার প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করছে আপনি দশক দশক ধরে তৈরি এই মায়াবী মতাদর্শের আলখাল্লা থেকে কতখানি বাইরে বেরোতে পারছেন তার ওপর। ইতিহাসকে ব্যাকট্র্যাক করে এই টুইস্টেড ন্যারেটিভের সঙ্গে যে জীবনপণ লড়াই করতে হবে, তার জন্য আপনার প্রস্তুতি কতখানি?
* সুমন রহমান : সাহিত্যিক; ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষক