দেশের অধিবাসীদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সহনীয় বা সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া নিশ্চিত করাই হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে এবং ২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে (এসডিজি) অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর দেশগুলোকে তা অর্জনে জোরালো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। বাংলাদেশ জাতিসংঘের এই লক্ষ্যকে (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৩.৮) সামনে রেখে এগিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না; বরং ক্রমে পিছিয়ে পড়ছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যের দুটি সূচক নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, যার একটি হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৩.৮.১) এবং অন্যটি হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা–সংক্রান্ত আর্থিক ঝুঁকি নিরসন (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৩.৮.২)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রথম সূচকটিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। আর্থিক মাত্রাটি বিবেচনায় নিলে অর্থাৎ দ্বিতীয় সূচকে বাংলাদেশ যে আরও পিছিয়ে রয়েছে, তা বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে সহজে অনুমেয়।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ২০১২ সালে স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্র তৈরি করে। এ লক্ষ্য অর্জনে জোরালো অঙ্গীকার দেখালেও এর অব্যবহিত পর থেকেই উল্টো পথে চলা শুরু করে। ২০১২ সালে চিকিৎসার জন্য রোগীরা গড়ে ৬৪ শতাংশ অর্থ নিজের পকেট থেকে খরচ করতেন যা ফি বছর বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালে ৭৪ শতাংশে পৌঁছে। যদিও কৌশলপত্রের উল্লেখিত লক্ষ্য ছিল ২০৩২ সালের মধ্যে সেটি ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনা।
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে চিকিৎসায় রোগীর নিজের পকেট থেকে অর্থ খরচের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান সর্বোচ্চ এবং সারা বিশ্বে সপ্তম। সুতরাং সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জনের দৌড়ে বাংলাদেশ যে অনেক বেশি পিছিয়ে আছে তা বলাই বাহুল্য।
রোগীর পকেট-নির্ভর এই স্বাস্থ্য-অর্থায়ন প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীলতার কারণে দুটি বিষয় ঘটে থাকে। এক. দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণে বিরত থাকে বা চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। দুই. যাঁরা নিজের পকেট থেকে (সঞ্চয়, ধার-দেনা, সম্পদ বিক্রি ইত্যাদি) চিকিৎসা ব্যয় মিটিয়ে থাকেন, তাঁদের একটি বড় অংশ আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হোন, এমনকি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যান। চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে ক্রমবর্ধমান পকেট-নির্ভরশীলতার কারণে বাংলাদেশে আর্থিক বিপর্যয় বিগত বছরগুলোতে ক্রমে বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ২০১০ সালে যেখানে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ (প্রায় ৫০ লাখ) পরিবার আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, ২০১৬ সালে তা ২৪ দশমিক ৬ শতাংশে (প্রায় ৮৬ লাখ) এসে পৌঁছায়। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বেসরকারি খাতের ওপর চিকিৎসা নির্ভরশীলতার কারণে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সেবা গ্রহণে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। এটা সহজেই অনুমেয় যে স্বাস্থ্যসেবা বেসরকারি খাতের ওপর যত বেশি নির্ভরশীল হবে, রোগীদের আর্থিক বিপর্যয়ে পড়া ও দরিদ্র হওয়ার আশঙ্কা ততই বাড়বে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জনে এমন ব্যর্থতার কারণ বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাসেবার চাহিদার পরিধি বেড়েছে। যেমন বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি রোগ (বহুমূত্র, হৃদ্রোগ, ক্যানসার ইত্যাদি) বহুলাংশে বাড়ার কারণে চিকিৎসার চাহিদাও বেড়েছে। কিন্তু এই চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবার পরিমাণ ও মান বাড়ানোর উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে লাভজনক বেসরকারি হাসপাতালের দিকে রোগীরা যেতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছে। এমনটা হওয়ার পেছনে চিকিৎসাসেবাকে লাভজনক বেসরকারি খাতের কাছে অধিকতর মাত্রায় তুলে দেওয়াকে দায়ী করা যেতেই পারে।
এমনও হতে দেখা যায় যে, সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা প্রদানে অনীহা এবং অদক্ষতার কারণে রোগীরা সেখানে সেবা নিতে গিয়েও ফিরে আসেন এবং বেসরকারি হাসপাতাল থেকে উচ্চ মূল্যে নিজের অর্থ ব্যয় করে সেবা কেনেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অর্থাভাবে চিকিৎসা নিতে না পারা জনগোষ্ঠীর খুব সামান্য তথ্যই গবেষণা বা পরিসংখ্যানে এখন পর্যন্ত উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মানুষের স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিজের পকেট থেকে যে ব্যয় হয়, তার ৬৫ শতাংশই যায় ওষুধ কিনতে। অন্যদিকে ওষুধের বাজার তুলনামূলক কম নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় ব্যাপকভাবে ওষুধ বাজারজাত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা ব্যবস্থাপত্রে অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার রোগনির্ণয়ের পরীক্ষার ওপর আস্থাহীনতার কারণে একই রোগের জন্য রোগীরা একাধিকবার নিজ অর্থ ব্যয় করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন; যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকের কাছে সেবা নিতে রোগীদের মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে চিকিৎসার ব্যয় বেড়েই চলেছে।
চিকিৎসায় সরকারি অর্থায়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিমা আর্থিক বিপর্যয় এড়ানোর বিকল্প একটি ব্যবস্থা। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকি নিতে খুব একটা দ্বিধা করেন না এবং তাঁদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিমার প্রতি আস্থার অভাব রয়েছে। ফলে এ দেশে স্বাস্থ্য অর্থায়নে স্বাস্থ্যবিমা খুব একটা গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে বলে মনে হয় না। বরং কর–নির্ভর ব্রিটিশ স্বাস্থ্যব্যবস্থার (এনএইচএস) মডেলটি যুক্তরাজ্যসহ কল্যাণরাষ্ট্রগুলোতে (সুইডেন, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি) যে সফলতা দেখিয়েছে, বাংলাদেশের তার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। সরকারের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা থাকলেই এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে সফলতার মুখ দেখতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি নামে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা মডেল আকারে কিছু উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে সেবার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হলেও তাতে সমন্বয় ও সেবাদানকারীদের আগ্রহের অভাব লক্ষণীয়। বিভিন্ন কারণে এই কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য দৃশ্যমান কোনো সুফল দেখা যায়নি।
বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি (যদিও কেবল এ কয়টি পদক্ষেপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না)। পদক্ষেপগুলোকে তিনটি ক্ষেত্রে বিভক্ত করা যায়—১. স্বাস্থ্যসেবাপদ্ধতি; ২. স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও ৩. স্বাস্থ্য অর্থায়ন।
প্রথম ক্ষেত্রে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ানো ও দক্ষতার সঙ্গে তা কার্যকর করা (যেমন রেফারেল–পদ্ধতি প্রবর্তন) এবং ওষুধের বাজার ও চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ন্ত্রণ করা। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, প্রাথমিক চিকিৎসার পরিধি বৃদ্ধি ও গণস্বাস্থ্য–সংক্রান্ত পদক্ষেপ জোরদার করা, সরকারি হাসপাতালে সেবার পরিমাণ ও মান বৃদ্ধি করে রোগীদের আকৃষ্ট করা। তৃতীয় ক্ষেত্রে, সরকারের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও দক্ষতার সঙ্গে তার ব্যবহার নিশ্চিত করা; বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের ব্যয় যৌথভাবে সরকার ও রোগীদের বহন করা; যেখানে রোগীদের ব্যয় সহনীয় রাখা। এতে যেন বেশির ভাগ বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষের সেবা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
এ পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের জন্য জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি বাংলাদেশকে আরও কিছু বিষয় মাথায় রেখে এগিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন ২০১৯ সালে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের মিটিংয়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রদত্ত সুপারিশগুলো পরিপালনে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতি জোর দেওয়া। সেগুলো হচ্ছে—১. স্বাস্থ্যের বাইরেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করা; ২. কাউকে পেছনে ফেলে না রাখা; ৩. যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রণয়ন করা; ৪. সেবার মান উন্নত রাখা; ৫. অধিক ও ভালোভাবে বিনিয়োগ করা এবং সর্বোপরি ৬. অংশীজনদের নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়া।
বাংলাদেশকেন্দ্রিক বাধা ও সুযোগগুলো মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
জাহাঙ্গীর খান: স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ও সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।