জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে সংস্কার ও পুনর্গঠনের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪
জুলাই–আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে সংস্কার ও পুনর্গঠনের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪

নতুন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের প্রশ্ন এলে অযুত সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়ে আমার দুই দশকের গবেষণালব্ধ উপলব্ধি থেকে আজকের আলোচনায় আমি ন্যূনতম কিন্তু মৌলিক কিছু সংস্কারের প্রস্তাব তুলে ধরছি, যার বাস্তবায়ন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কিছুটা পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে।

আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলোর মূল সমস্যা দলের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ না ঘটা। অর্থাৎ, রাজনৈতিক দলকে একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা, যে চর্চাটি আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যেই গড়ে ওঠেনি। দলের কার্যালয় ও গঠনতন্ত্রের বাইরেও এর কিছু লিখিত ও অলিখিত কার্যবিধি থাকবে, কিছু সার্বক্ষণিক বেতনভুক্ত স্টাফ থাকবে। দলে সবৈতনিক যোগাযোগ পেশাজীবী, জনমত বিশ্লেষক, গবেষক ও কৌশলবিদ থাকবে। অর্থাৎ দল কেবল সমাজের মধ্যকার মত, পথ ও চিন্তার প্রতিনিধিত্বশালী রাজপথের শক্তিই হবে না। এর সঙ্গে একটি করপোরেট প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও থাকবে, যেখানে একগুচ্ছ দাপ্তরিক কাজের জন্য একদল সবৈতনিক পেশাজীবী নির্বাহী থাকবে।

প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিষ্ঠান হিসেবে না দাঁড়ানোর ফলে কিছু অবশ্যম্ভাবী সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলো পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজে পিছিয়ে থাকে। যদিও কেউ কেউ অস্থায়ী ভিত্তিতে বাইরের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে কিছু কাজ করিয়ে নেয়, অথবা আরও খারাপ উদাহরণ হিসেবে দলের মাঠের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এসব কাজে সম্পৃক্ত করে। এতে দলে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও স্মৃতি গড়ে ওঠে না। একধরনের ‘অ্যাডহকিজম’ দিয়ে দলের পেশাদার কাজগুলো চালানো হয়।

আমার বিবেচনায় দ্বিতীয় প্রধান এবং বহুল আলোচিত সমস্যাটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রহীনতা। এটি কিছু ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সমস্যার সম্পূরক কিংবা তার চেয়েও ভয়াবহ। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নির্বাচনপ্রক্রিয়ার কিছু প্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচলিত নিয়মকানুন রয়েছে। ভোটের মাধ্যমে তৃণমূল থেকে শুরু করে সব স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের নির্বাচন যেকোনো রাজনৈতিক দলের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখার জন্যই জরুরি। কারণ, এতে সমাজে কী ঘটছে, কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারা কীভাবে সামাজিক শক্তিগুলোকে বিনির্মাণ করছে এবং কাদের সঙ্গে মানুষের ও দলের কর্মীদের সংযোগ রয়েছে, এর একটি পরিপূর্ণ চিত্র একটি রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে উঠে আসার কথা। গণতান্ত্রিক পন্থায় নেতৃত্ব নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোকে সমাজের প্রাসঙ্গিক শক্তি হিসেবে সমাজের চাহিদার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ তৈরি করে। এর অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি, পরিবার ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কবলে পতিত হয়। যার চূড়ান্ত প্রভাব সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও এসে পড়ে। বাংলাদেশে কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা তা–ই দেখেছি।

সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া

আমার বিবেচনায় তৃতীয় বড় সমস্যাটি অর্থায়নের। এটি যতটা না অর্থের সরবরাহের, তার চেয়ে বেশি এর প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দল পরিচালনার জন্য অর্থ প্রয়োজন। সেটি দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের চাঁদা থেকেই আসবে। এদের মধ্যে ব্যক্তিপর্যায়ের দাতা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও নানা শ্রেণি–পেশার সামর্থ্যবান মানুষ থাকতে পারে। রাজনৈতিক দলে চাঁদা প্রদান বিশ্বজুড়েই একটি বৈধ ও গ্রহণযোগ্য পন্থা। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের চাঁদা প্রদানের বিষয়টিকে রীতিমতো লুকোচুরি ও অপরাধের পর্যায়ে পর্যবসিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলে যেকোনো দান, অনুদান, চাঁদা জনস্বার্থ–সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে এগুলোকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। কারা কোন দলে কত টাকা চাঁদা দিচ্ছে এবং তাদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব কী, এটি সে দলের কর্মী-সমর্থকদের এবং সর্বোপরি জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, বার্ষিক নিরীক্ষার মাধ্যমে আয়-ব্যয়ের পরিপূর্ণ হিসাব জনগণের জন্য তুলে ধরা ন্যূনতম কাজ। এর জন্য রাজনৈতিক দলের আইনি কাঠামো সংশোধন দরকার হলে তা করতে হবে।

দলের নেতৃত্বের সময়সীমা নিয়েও অনেক আলোচনা-সমালোচনা বিদ্যমান। অনেকে দলের নেতৃত্বের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পক্ষপাতী। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে এর প্রয়োজন হবে না। একজন ব্যক্তি তার গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে একাধিকবার কোনো পদে নির্বাচিত হওয়ায় সমস্যা কম যদি প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতা উন্মুক্ত হয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা সমসাময়িক বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় রাজনৈতিক দলের মোকাবিলা করা কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করতে পারি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে সে ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারে এবং আমরা কীভাবে এ সমস্যাগুলো এড়াতে পারি, তা নিয়েও আলোকপাত হওয়া জরুরি। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক দলগুলোয় যে সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে, সেটি হলো দলগুলোয় অর্থায়নকারী বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা গণতন্ত্রে সমস্যাটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এর ফলে সেখানে দলের নীতি নির্ধারণে প্রায়ই জনস্বার্থের চেয়ে সংশ্লিষ্ট ওই গোষ্ঠীগুলোর চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষাই প্রতিফলিত হয়।

এটি গণতন্ত্রের মৌলিক সমস্যা এবং একটি অশনিসংকেতও বটে। কারণ, গণতন্ত্রের কার্যকরতার একটি পূর্বানুমান হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো সমাজের বিভিন্ন আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করবে এবং শাসনপ্রক্রিয়ায় যার প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনস্বার্থের চেয়ে গোষ্ঠীস্বার্থ বড় হয়ে ওঠার ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বৈধতাই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। এ সমস্যা প্রকট ও এগুলো সারানোর নানা চিন্তা জারি রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সংস্কারে আমরা এটি বিবেচনায় নিতে পারি। আমার প্রস্তাব হচ্ছে রাজনৈতিক দলে যেকোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাঁদার হারের সর্বোচ্চ সীমা ঠিক করে দেওয়া, অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনো দলের মোট বার্ষিক চাঁদার ২ শতাংশের বেশি না দিতে পারা। আলোচনার ভিত্তিতে পরিমাণটি কমবেশি করা যেতে পারে। এ ধরনের বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলো যাতে অর্থসংকটে না পড়ে, সে জন্য তাদের ব্যাপক হারে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহের দিকে যেতে হবে। প্রক্রিয়াটিকে ডিজিটাইজড করার মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছে এ আবেদন করা যায়। এর মাধ্যমে দলে গোষ্ঠীস্বার্থ সীমিত হবে। তবে এর সাফল্য নির্ভর করছে পুরো প্রক্রিয়াটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ওপর।

* সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া: ডিয়াসপোরা ফর জাস্টিসের প্রতিষ্ঠাতা; সাউথ এশিয়া পারস্পেক্টিভস–এর (ওয়াশিংটন) সহযোগী সম্পাদক; ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের ডক্টরাল গবেষক