কর্মীর লেখা

আমাদের ছুটুটু, আমাদের পুটুটু

প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

আমি যে বিষয়ে লিখছি, আসলে এটা সবার ঘরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু আমার কাছে এ যে অতি বিশেষ কিছু, সোনার হরফে তা মুদ্রিত করে রাখার মতোই। যার কথা লিখছি, সে অতি চঞ্চল, দুষ্টের শিরোমণি আমাদের ছোট ছেলে শাফিন।

কিছুদিন হলো আমাদের শাফিন বাবু নতুন পা পেয়েছে, অর্থাৎ হাঁটতে শিখেছে। গুটি গুটি পায়ে সারা বাড়ি হেঁটে সারা দিন ব্যস্ত থাকে, সবাইকে ব্যস্ত রাখে। তার দুই হাত পেছনে নিয়ে হাঁটা তো অপূর্ব সুন্দর! কখনো মাথায় বেঢপ টুপি পরে, কখনো অন্য কোনো কাপড় পেঁচিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আর খলবলিয়ে হাসে। কখনো বড়দের জুতা পায়ে হেঁটে যেতে থাকে।

জীবন তো এক নকশিকাঁথা। দীর্ঘ সময়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ধৈর্যের ফল একেকটি নকশিকাঁথা। গৃহবধূর সুচের প্রতিটি ফোঁড়ে যেমন লুকিয়ে থাকে কত আবেগ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা।

এমনই অসাধারণ খেলায় তার কাটে সারা বেলা। আব্বু-আম্মু ছাড়া তেমন কিছু বলতে শেখেনি। বাসায় বিভিন্ন খেলার সরঞ্জাম নিয়ে খেলা করা, দোমড়ানো-মোচড়ানো ও নষ্ট করা, চাবি নিয়ে তালা খোলার ব্যর্থ চেষ্টা এবং সারা দিন হুড়মুড়-ভাঙচুর। দুষ্টুমির সময় চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে।

পানি বা কিছু খেতে চাইলে বলে মাম খাবে। ভয় পেলে বলে পোকা পোকা। গোসলের সময় হলে ট্যাপের পানি ছাড়া, বালতিতে ওঠা এবং মগ মগ পানি নষ্ট করা তার কাজ। তার বড় ভাইয়েরা কেউ তাকে লাইভ বেবি কার্টুন বলে, কেউ বলে কাণ্ডকীর্তি। প্রতিদিন অশেষ কাণ্ডকীর্তি দেখিয়ে সে সবার হাসির খোরাক জোগায়। এভাবে আমাদের ব্যস্ত জীবনে প্রায় হাসতে ভুলে যাওয়ার পরিবর্তে হাসির বন্যা বয়ে যায়।

জীবন তো এক নকশিকাঁথা। দীর্ঘ সময়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ধৈর্যের ফল একেকটি নকশিকাঁথা। গৃহবধূর সুচের প্রতিটি ফোঁড়ে যেমন লুকিয়ে থাকে কত আবেগ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা। তারপরই তৈরি হয় দৃষ্টিনন্দন একটি নকশিকাঁথা। সে রকমই আমাদের আদরের ধন শাফিন কখনো অসুস্থ হলে অনেক দুশ্চিন্তা হয়। কখনো খাট থেকে পড়ে যায়, আবার কখনো আছাড় খেয়ে কান্না করে। কত কষ্ট পায়, ব্যথা পায়, কখনো ছোট ছোট রোগব্যাধি এসে কিছু সময়ের জন্য থমকে দেয় চেনা সব পরিবেশ। আবার রোজকার মতো সবকিছু পাশ কাটিয়ে তার বিরামহীন আনন্দে ছুটে চলার মতোই বড় হচ্ছে আমাদের সবার প্রিয় ছুটুটু শাফিন।

তাকে আদর করে ডাকি ছুটুটু, পুটুটু, পুষিটি, পুলিনি, এমন সব অর্থহীন নামে। এমন নামগুলোতে ডেকে প্রাণ জুড়াই।

শাফিনের বয়স এখন ১৫ মাস। ২০২৩ সালের ১ আগস্ট সকাল পৌনে দশটার সময় তার জন্ম হয় লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সে আনন্দঘন মুহূর্তে আমার স্ত্রীর পাশে থাকতে না পারার কষ্ট আমি চিরকাল ভুলতে পারব না। তার কাছে আমি ক্ষমা চেয়েছি।

সেদিন ভোরে অনাগত সেই সন্তানের জন্ম হবে, এ খবর পেয়ে আমি শশব্যস্ত হয়ে ঢাকা থেকে বাসে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। পথে যেতে যেতে আমার মাথায় দুশ্চিন্তার ফল্গুধারা বয়ে যাচ্ছিল। একসময় হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী তপতী রায় আমাকে শোনালেন সেই অপরিমেয় আনন্দ-সংবাদটি, ‘আপনি ছেলে বাবুর বাবা হয়েছেন। মা-ছেলে দুজনেই সুস্থ আছে।’ আমার স্ত্রীর এটা ছিল স্বাভাবিক প্রসব। তাঁর অসমসাহস, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আর অনেক ধৈর্য ছিল বিধায় আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা একটি সুস্থ ফুটফুটে বাচ্চা পেয়েছি। বাচ্চার মা বলেছিল, ‘আমি কোনো দিন সিজারিয়ানের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেব না। কারণ, ওতে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হবে, ভোগান্তি পোহাতে হবে অনেক। আর বলিউড অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাইও স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্ম দিয়েছেন।’ তার এমন সাহসে আমিও ভরসা পাই।

খুশিতে আত্মহারা হয়ে অনেককে ফোনে জানাচ্ছি ছেলের ভূমিষ্ঠ হওয়ার সে খবর। রংপুর মডার্ন মোড় পার হচ্ছি, এ সময় প্রথম আলো থেকে পিএবিএক্সের সিনিয়র টেলিফোন অপারেটর প্রবীরদা শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানিয়ে অনেক জমাটি আলাপ করতে থাকলেন। আমার খুশি আর ধরে না। পড়িমরি ছুটছি বাড়ির টানে। অবশেষে প্রায় সন্ধ্যাকালে বাড়ি পৌঁছে দেখলাম সেই চাঁদমুখ, পরম মমতায় জড়িয়ে নিলাম বুকে। পৃথিবীটা যেন জয় করে ফেলেছি আমি।

তাকে আদর করে ডাকি ছুটুটু, পুটুটু, পুষিটি, পুলিনি, এমন সব অর্থহীন নামে। এমন নামগুলোতে ডেকে প্রাণ জুড়াই।

এখন সে কোলে উঠে আমার বুকের পশমগুলো হাতের মুঠোয় পুরে জোরসে টান দেয়। আমি ব্যথা পাই, এতে সে অনেক খুশি হয়। তার মা ও ভাইদের সঙ্গে অশেষ দুষ্টুমি করে। খাটের নিচে, দরজার পাশে লুকিয়ে থেকে আমাদের চমক দেখায়। প্রতিদিন জানালার সামনের গাছে বসে থাকা পাখির গান শুনে, বিড়াল দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে তাদের ডাকে। তারা তার দূরের খেলার সাথি। মুঠোফোনে সে মজার মজার কার্টুন ও ছোট্ট সোনামণিদের বিভিন্ন ভিডিও দেখে মশগুল হয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে তাকে নিয়ে রমনা পার্ক, ধানমন্ডি লেকের পাড় ও হাতিরঝিলে যাই। সেখানে সে এমন বেগে হাঁটে যেন মনে হয় এই বুঝি পড়ে যায়, অথচ না। অফুরন্ত খুশিতে মগ্ন হয়ে যায়। সপ্তাহে এক দিন এভাবে খোলা আকাশের নিচে সবার মাঝে নিয়ে যাই। এখানে শিশুদের খেলার সরঞ্জামগুলো পেয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলায় মাতে। বাসার বাইরে যাওয়ার জন্য শার্ট গায়ে দেওয়া দেখলে আর রক্ষা নেই, তাকে কোলে নিয়ে বাইরে কিছু দূর যেতে হবে, তারপরই তার থেকে ছোটা সম্ভব হয়। তাকে নিয়ে এমন সব হাজারো তামাশায় কাটে বেলা।

অনেক সুন্দর সুন্দর লেখা প্রতিযোগিতার ভিড়ে আমাদের আদরের ধন কতটা বিচারকের হৃদয় জয় করতে পারবে, সেটাই ভাবছি। যদি না পায় টিকতে, সান্ত্বনাটা যেন থাকে সবার, সেটাই আমার দাবি।

আপনারা সবাই আমাদের শাফিন বাবুর জন্য দোয়া করবেন, যেন সে দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়। ছুটুটু আমাদের পরিবারের হিরো, সে আমাদের নয়নমণি।

  • মো. আবদুল বাছেদ, জ্যেষ্ঠ সম্পাদনা সহকারী