জীবন বহতা নদীতে চলমান নৌকার মতো। এই ঘাটে ভেড়া, ওই আবার চলা। ২৮ বছরের সামরিক চাকরি শেষে অবসরে এসে প্রথম আলোর মতো বিখ্যাত পত্রিকায় চাকরি হবে—এটি আমার ভাবনাতেই ছিল না। সৃষ্টিকর্তাই হয়তো সবকিছু ঠিক করে রেখেছিলেন।
আমার চাকরির ইন্টারভিউটা ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। সামরিক চাকরিজীবনে করেছি লেফট-রাইট আর প্যারাজাম্প, পার্বত্য চট্টগ্রামে চালিয়েছি শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান। এবার এখানে ইন্টারভিউ দিতে এসে পড়লাম মহাফাঁপরে।
লরেন্স শ্যামল মল্লিক তখন প্রথম আলোর মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান। ২০১২ সালের ২ নভেম্বর আমাকে অফিসে ডেকে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, প্রশ্নের উত্তরগুলো ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে দিতে হবে। প্রশ্নগুলো দেখে প্রথমে একটু ভ্যাবাচেকা খেলাম। নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে জুতার ফেরিওয়ালাদের মারামারি, প্রথম আলোর কর্মীদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ, প্রথম আলোর কার্যালয়ের ভেতরে চুরি হলে কী করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
যা হোক, প্রেজেন্টেশন শেষ করলাম। সম্পাদক মতিউর রহমান—মতি ভাই সব সময় প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে যেভাবে বলেন, সেভাবে বললেন, ‘দেখেন, বোঝেন, ভাবেন।’ সবার ভাবনা শেষে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক পদে শেষ পর্যন্ত আমার চাকরি হয়ে গেল। ১২ নভেম্বর প্রথম আলোয় আমার চাকরির এক দশক পূর্ণ হবে।
এই ১০ বছরের বিভিন্ন স্মৃতি আমাকে মাঝেমধ্যেই তাড়া করে। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গিয়ে আমাকে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখিও পড়তে হয়েছে। একটার কথা বলি।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা হিংসাত্মক রূপ নেয়। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার কারওয়ান বাজারে একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন। সেদিন একদল সন্ত্রাসী তাদের মিছিল থেকে আচমকা পার্কিং এলাকায় গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমার মোটরসাইকেলটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফুয়েল ট্যাংকটি ফুটো হয়ে গিয়েছিল। এই গোলাগুলির মধ্যে আনিসুজ্জামান স্যার তখন ওয়াসা ভবনের সামনে একটা বৈদ্যুতিক খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মতি ভাই আমাকে বললেন, ‘সাজ্জাদ ভাই, আনিস স্যারকে একটু আনতে পারবেন?’
আমি দৌড়ে ওয়াসা ভবনের সামনে থেকে আনিস স্যারের হাত ধরে, বলতে গেলে প্রায় টেনে সিএ ভবনের ভেতর নিয়ে আসি। স্যার সে সময় খুব হাঁপাচ্ছিলেন। সে অবস্থায় আমাকে বললেন, ‘অহেতুক গুলি খেয়ে মরার চেয়ে বৃদ্ধ বয়সে একটুখানি দৌড়ে ব্যায়ামটা ভালোই হলো।’
এর পর থেকে মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা শ্যামল ভাই আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘সাজ্জাদ ভাই, সেদিন গোলাগুলির মধ্যে কীভাবে গেলেন আর এলেন—ভাবতে পারি না।’ আনিস স্যারও প্রথম আলোয় যখনই আসতেন, আমাকে দেখলেই সেদিনের কথা এমনভাবে বলতেন যেন নতুন কোনো গল্প শুনছি।
আরেকটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলে লেখাটি শেষ করব।
প্রিয় এক সহকর্মী, দেশজোড়া যাঁর খ্যাতি, হঠাৎ এক সন্ধ্যায় ফোন দিয়ে বললেন, ‘সাজ্জাদ ভাই, আমার মোটরসাইকেলের স্ট্যান্ড আর কিক প্যাডেল কে যেন নষ্ট করে দিয়েছে! আপনার নিরাপত্তাকর্মীরা কী করে?’ আমি বললাম, ‘ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ আমার প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা কর্মকর্তা কফিল যা বললেন, সে কথা শুনেই আমার চক্ষু চড়কগাছ, ‘স্যার, উনি তো জিয়া (মনজুর কাদের) স্যারের মোটরসাইকেল নিয়ে চলে গেছেন! একই মডেলের দুটি মোটরসাইকেল। জিয়া স্যারের মোটরসাইকেলের স্টার্ট স্লট সম্ভবত খারাপ থাকায় তাঁর সহকর্মীর চাবিতেই চালু হয়ে যায়।’
মিনিট খানেক পরেই সহকর্মীটি ফোন করে বললেন, ‘সাজ্জাদ ভাই, মেকানিক বলল এই মোটরসাইকেল আমার নয়।’ আমি বললাম, ‘ভাই, অফিসে আসেন। আপনার মোটরসাইকেল পাওয়া গেছে।’ কী আর করা, সৃষ্টিশীল আর গানপাগল মানুষেরা বোধ হয় এমনই হয়ে থাকেন।
লেখক: হেড অব সিকিউরিটি