প্রথম আলোর ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
ওদের একসময় ছিল বসতভিটা। ছিল আবাদি জমি, গোয়ালভরা গরু। নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে আশ্রয় হয়েছে তিস্তা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে। সেই সময় রংপুর অঞ্চলে অভাব লেগেই থাকত। খেতে কাজ নেই। কষ্ট পিছু ছাড়ছিল না। ঈদের দিন যে একটু আনন্দ করবে, গায়ে নতুন কাপড় পরবে, সেমাই পোলাও খাবে, এমন সামর্থ্যও ছিল না তাদের। ওদের মুখে হাসি ফোটাতে ঈদের দিনের আনন্দ দিতে ছুটে যাই নদীপারে। একেবারে যারা নিঃস্ব, তাদের তালিকা করা হয়। সেই তালিকা ধরে ধরে ঈদের আগের দিন সেমাই, চিনি, লবণ, তেল, পোলাও চাল, সেদ্ধ চাল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রথম আলোর সাহায্য পেয়ে ওদের মুখে হাসি দেখেছি। ঈদে নতুন শাড়ি-লুঙ্গি, শিশুদের রঙিন জামা পেয়ে অনেককে আনন্দে কাঁদতেও দেখেছি। সেই দিনের কথা মনে পড়ে। তখন আমার বুকটা ভরে যায়।
রংপুরে অভাবের সময় কোনো এক রমজানের ঈদ। আকাশে চাঁদ উঠেছে। শহরের মানুষজন চাঁদরাতেই আনন্দে উল্লসিত। এমন এক পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হলো, ঈদের দিনই গ্রামের অভাবী পরিবারদের মনটা রাঙিয়ে তুলতে হবে। ঈদের নামাজ পড়ে দুটি মোটরসাইকেলে আমরা চারজন ছুটে চলি নদীপারের কষ্টে থাকা মানুষের পাশে। এই শুভযাত্রায় যুক্ত ছিলেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক, শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু, স্থানীয় সাংবাদিক স্বপন চৌধুরী ও আমি। বাঁধে আশ্রিতদের প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে ওই সময় নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়। ঈদের আনন্দ পেতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় প্রথম আলো। এভাবে ঈদের সময় কষ্টে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা আরও অনেক রয়েছে। ভালো কাজের এসব স্মৃতির কথা মনে পড়লে তখন আমার বুকটা ভরে যায়।
রংপুরের স্কুলশিক্ষার্থী মাসুদা আক্তারের মুখটা বারবার ভেসে আসছে। মায়াবী সুন্দর মুখটি অ্যাসিডে ঝলসে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। তাঁর দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। তিনি চিরতরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। সেই অসহায় মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছে প্রথম আলো। তিনি দুই চোখে দেখতে না পারলেও প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় লেখাপড়া করছেন। পড়ছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষ বর্ষে। কষ্টের মধ্যেও অদম্য মনোবল আর ইচ্ছাশক্তি নিয়ে মাসুদা এখনো অবিচল। তাঁকে অ্যাসিড ছুড়ে মারা দুর্বৃত্ত ব্যক্তিকে ফাঁসির রায়ও দিয়েছেন বিচারক। তখন আমার বুকটা ভরে যায়।
প্রিয় সেই পত্রিকা প্রথম আলোর ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রজতজয়ন্তীর শুভক্ষণে বিচিত্র স্মৃতিবহুল অনেক ঘটনার কথাই মনে পড়ছে। মনে পড়ছে রংপুরে গণিত উৎসবের শুরুর কথা। উৎসব হবে, করতে হবে শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। আমি, আমার সহধর্মিণী রেহানা সুলতানাসহ বন্ধুসভার সদস্যদের নিয়ে ছুটে চলি বিভিন্ন স্কুলে। শিক্ষার্থীদের বোঝাতে থাকি। কিন্তু আমাদের ডাকে তেমন সাড়া পড়ে না। স্কুলের ভেতর ব্যানার টাঙিয়ে চেয়ার–টেবিল নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে তীর্থের কাকের মতো। কিন্তু নিবন্ধন খুব একটা হয় না। শিক্ষার্থীদের তেমন সাড়া না থাকায় শেষমেশ শিক্ষকদের অনুরোধ করে নিবন্ধনের কাজটি করতে হয়েছে। এভাবেই গণিত উৎসবের সূচনা হলেও একসময় এসে সেই গণিত উৎসবে অংশ নিতে মহাকাণ্ড ঘটেছে। এক দিনেই এক হাজার নিবন্ধন শেষ হয়েছে। আমাদের কোনো স্কুলেও ছুটে যেতে হয়নি। রংপুরে প্রথম আলো অফিসে এসে শিক্ষার্থীরা লাইন ধরে নিবন্ধন করেছে। গণিতে অংশ নেওয়া সেই সোনার ছেলেরা বিদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক গণিত উৎসবে সোনার মেডেল পরে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। প্রথম আলোর কর্মী হিসেবে ভালো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরেছি। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে তখন আমার বুকটা ভরে যায়।
দীর্ঘ ২৫ বছরের পথচলায় আরও কত স্মৃতি। রংপুরের সাহেবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রেনু ফাতেমা একদিন মুঠোফোনে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ভাইয়া, আমি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছি।’ এ যেন তাঁর আনন্দের কান্না। রেনু ফাতেমার পাশে দাঁড়িয়েছিল প্রথম আলো ট্রাস্ট। তিনি অদম্য মেধাবী। তাঁর মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। পড়াশোনার খরচ চালাতে পারতেন না। তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোয় খবর হয়। আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসে প্রথম আলো। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে তিনি এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেই সঙ্গে তিনি ডক্টর অব ফেলোশিপ (পিএইচডি) করছেন। এমন আনন্দের খবর শুনে কার না ভালো লাগে। তখন আমার বুকটা ভরে যায়।
তখনো প্রকাশিত হয়নি প্রথম আলো পত্রিকা। কারওয়ান বাজার এলাকার একটি ভবনে বসা হতো। ঘরের মেঝেতে লাল কার্পেট বিছানো ছিল। এর ওপর কাগজ বিছিয়ে পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছিল। কী কী হবে, কেমন হবে। কোন কোন বিশিষ্ট লেখকের লেখা যাবে। উদ্বোধনী সংখ্যা কেমন হবে। সেই কাজের সময় আমিও উপস্থিত থেকে যুক্ত থেকেছি। পত্রিকা প্রকাশের শুরু থেকেই কাজ করে আসছি। প্রথম দিনই রংপুরে বিশিষ্টজনসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার পাঠকদের হাতে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। প্রথম দিনেই পত্রিকার জয়জয়কার দেখেছি। আজ সেই পত্রিকার রজতজয়ন্তীতে এসে মনে পড়ছে সেই দিনগুলোর কথা। সেই পত্রিকা আজ দেশের শীর্ষ দৈনিক। তখন আমার বুকটা ভরে যায়।
পত্রিকা প্রকাশের আগে কোনো একদিন ভোরের ঘটনা। বিছানার পাশে থাকা ল্যান্ডফোনটির রিং বেজেই চলেছে। ফোনটি ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে মতি ভাইয়ের কণ্ঠ ভেসে এল। প্রথম আলোর সম্পাদক। মতিউর রহমান বললেন, ‘রুজু কেমন আছ।’ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম, ‘ভালো আছি।’ সেই ২৫ বছর আগে ভোরবেলা যিনি ফোন দিয়ে প্রথম আলো পত্রিকা প্রকাশের কথা জানিয়ে কুশলবিনিময় করলেন, সেই প্রিয়জন এখনো খবর নেন। শুধু আমার একার নয়, পুরো পরিবারের খোঁজখবর নিতেও ভোলেননি। ২৫ বছর থেকে প্রথম আলোর সঙ্গে পথচলায় সেই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। তখন আমার বুকটা ভরে যায়