কর্মীর লেখা

জল্পনা–কল্পনার ঘরে এল গুজব-গুঞ্জন

প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

জল্পনার বিয়ে হলো কল্পনার সঙ্গে। তাদের কোলজুড়ে এল যমজ সন্তান। একটা ছেলে। একটা মেয়ে। জল্পনা-কল্পনা ছেলের নাম রাখল গুজব, মেয়ের নাম গুঞ্জন।
গুজব, গুঞ্জন বড় হয়ে ফেকলুকে অ্যাকাউন্ট খুলল। তাদের বাবা-মার ফেকলুক ছিল না। একদিন ছেলে-মেয়ে তাদের বলল, ‘আব্বু, আম্মু তোমরাও ফেকলুকে আসো। দেখবা এখানে সব আমরা আমরাই। অনেক মজা!’

জল্পনা ও কল্পনা সন্তানদের কথা ফেলতে পারল না। তারা ফেকলুকে একটা করে অ্যাকাউন্ট খুলল। তারপর বলল, ‘আরে! সত্যিই তো! ফেকলুকে তো দেখি সব আমরা আমরাই! অনেক গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা! উফ্‌, কী আনন্দ! কী আনন্দ!’

জল্পনা, কল্পনা, গুজব, গুঞ্জনের দিন সীমাহীন আনন্দে কেটে যেতে লাগল। ফেকলুকে তাদের কতজন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। তারাও কতজনকে বন্ধু করে। আবার ফ্রেন্ডস অব ফ্রেন্ডসদের ওয়াল, এমনকি একেবারে অচেনাদের ওয়ালেও দেখা যাচ্ছে শুধু গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনার চর্চা। কী মজা! কী মজা!

একদিন একটা লিংকে খবর এল হীরক রাজার পরিষদ সভায় বসেছে। দারুণ তো! হীরক রাজা ফিরেছেন? ফেকলুকে যখন এসেছে নিশ্চয়ই ফিরেছেন। তা সভায় তাঁরা কী নিয়ে কথা বললেন?

গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনাকে সবাই খুব পছন্দ করতে লাগল। আহা! এই না হলে ফেকলুক! জল্পনা, কল্পনা, গুজব, গুঞ্জন—সব এক পরিবারে! এই তো চাই!
বাসে, মেট্রোতে, সড়কে, মহাসড়কে, অফিসে, বাজারে, ঘরে, বাইরে শুধু গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা আর গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা। কুউউউউল! জীবন পুরাই ভাইব্রেন্ট!

মোবাইলের স্ক্রিন থেকে কারও চোখ সরে না। আরে ওই তো, ওই স্ট্যাটাসটা—তালপুকুরপাড়ে তালগাছের ওপর নাকি কুমিরের বাসা পাওয়া গেছে। দাও লাইক, করো শেয়ার। একটা গ্রাফিকস কার্ড ঘুরছে সবার ওয়ালে ওয়ালে। কোনো এক মাঠে নাকি এক খেলোয়াড় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খেলেছে। ফেকলুকে যখন এসেছে, নিশ্চয়ই ঘটেছে। লাইক, কমেন্ট, শেয়ার চলছে, চলবে।

একদিন একটা লিংকে খবর এল হীরক রাজার পরিষদ সভায় বসেছে। দারুণ তো! হীরক রাজা ফিরেছেন? ফেকলুকে যখন এসেছে নিশ্চয়ই ফিরেছেন। তা সভায় তাঁরা কী নিয়ে কথা বললেন? যেই না মনে প্রশ্ন অমনি ফেকলুকে চলে এল একটা ভিডিও।

ভিডিও শুরু—রাজার মাথার ওপর পাখা দোলাচ্ছে পাখাল। সামনে বসা পারিষদ ওপর-নিচে মাথা নেড়ে চলেছে। হীরক রাজা কিছু বলছেন না। চোখ বুজে কী যেন ভাবছেন। তবে যেকোনো সময় নিশ্চয়ই কিছু বলবেন। তাতে সম্মতি দিতেই সবার আগে থেকে মাথা নাড়াতে থাকা। অকস্মাৎ রাজা বলে উঠলেন, ‘হীরা, চুনি, পান্না… আর না, আর না।’ সবার মাথা এবার জোরে জোরে ওপর-নিচ হলো। সঙ্গে কোরাস, ‘হীরা, চুনি, পান্না… আর না, আর না’—ভিডিও শেষ।

ফেকলুকের সঙ্গে এবার রিউকিউবও সচল হলো। ভিডিওর পর ভিডিও আসতে লাগল। হীরা, চুনি, পান্না…আর না, আর না! নাকে লাগে কিসের গন্ধ? রহস্য নাকি ষড়যন্ত্র! রাতারাতি সব বিশেষজ্ঞ।

এরপর সেই ভিডিও থেকে টুকরো টুকরো আরও ভিডিও হতে লাগল। পাখা নাড়ার ভিডিও। হীরক রাজার চোখ বুজে থাকার ভিডিও। পারিষদ সদস্যদের ওপর-নিচ মাথা নাড়ানোর ভিডিও। কোরাসের ভিডিও। সবচেয়ে বেশি ভাইরাল হলো ওই ভিডিও, যেখানে রাজা হঠাৎ বলে ওঠেন, ‘হীরা, চুনি, পান্না… আর না, আর না।’ ছোট ছোট ভিডিওগুলোর একটা নামও দেওয়া হলো—থ্রিল!

এসব ভিডিও আর থ্রিল দেখে শুরু হয়ে গেল থ্রিলার সব জল্পনা-কল্পনা। রাজা আসলে কী বলতে চেয়েছেন? ‘হীরা, চুনি, পান্না… আর না, আর না’ মানে কী? নিশ্চয়ই এর মহা কোনো তাৎপর্য আছে। কী সেই তাৎপর্য?

ফেকলুকের সঙ্গে এবার রিউকিউবও সচল হলো। ভিডিওর পর ভিডিও আসতে লাগল। হীরা, চুনি, পান্না…আর না, আর না! নাকে লাগে কিসের গন্ধ? রহস্য নাকি ষড়যন্ত্র! রাতারাতি সব বিশেষজ্ঞ।

একজনকে দেখা গেল হীরার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গ্লাসের ভেতর থাকা হীরা দেখিয়ে বুম ধরে হাত নেড়ে নেড়ে বলছেন—এই হীরা সেই হীরা নয়তো? আরেকজনকে পাওয়া গেল হীরাঝিল নামে এক রেস্টুরেন্টের সামনে। কিন্তু তিনি কী বললেন রাস্তার বাস-ট্রাকের শব্দে তা শোনা গেল না।

ওদিকে ফেকলুকে রটল, হীরা নামের সবাইকে এবার ধরা হবে। সে জন্যই রাজা বলেছেন, ‘… আর না আর না।’ নাম যেহেতু হীরা, অবশ্যই বিরাট বড়লোক। সম্পদশালী। এত সম্পদ কোথায় পেল যে নাম হীরা হলো? গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা। কার কয়টা রিসোর্ট, কার কয়টা ছাগল সব এবার খোঁয়াড় থেকে বেরিয়ে আসবে। কাউকে দেশ ত্যাগ করতে দেওয়া হবে না। হীরারা সব দৌড়ের ওপর।

এভাবে দিনে দিনে গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা জালের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল। রাতারাতি সেলিব্রিটি বনে গেল এক পরিবারের চারজন। তাদের খ্যাতি, তাদের নিয়ে আলোচনায় অন্তর্জাল ছেয়ে গেল। জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হতে লাগল।

একই অবস্থা পান্নাদের। পান্না তো অতি মূল্যবান পাথর। নাম কি আর এমনি এমনি পান্না! ঘরে নিশ্চয়ই সিন্দুকভর্তি পান্না পাথর। কোথা থেকে এল? কে দিল? ইনকাম ট্যাক্স দিয়েছে? গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা। পলায়নপর পান্নারা গা ঢাকছে। ঘুমের মধ্যেও কানে বাজছে সিপাহিদের বাঁশি, সাইরেনের শব্দ। কী বিপদ রে বাবা! বাঁচা, বাঁচা।

চুনি নামে কাউকে আপাতত পাওয়া গেল না। পাশের রাজ্যে একজন ছিলেন বল পায়ে বিখ্যাত চুনি, এখন নেই। কিন্তু নেই বলে কিছু নেই। চুনি নেই তো রুবি আছে। চুনি মানেই রুবি। অতি দামি পাথর। অর্থাৎ রাজা রুবিকেও বলেছেন, ‘আর না, আর না।’ তাহলে তারাই–বা বাদ যাবে কেন। ফেকলুকে ধর ধর রব। গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা, লাইক, শেয়ার, কমেন্ট। চলছে, চলবে।

এভাবে দিনে দিনে গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা জালের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল। রাতারাতি সেলিব্রিটি বনে গেল এক পরিবারের চারজন। তাদের খ্যাতি, তাদের নিয়ে আলোচনায় অন্তর্জাল ছেয়ে গেল। জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হতে লাগল। গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা ছাড়া রাজ্যের কারও চলেই না। তাদের ফ্রেন্ডলিস্ট বড় হতে লাগল। এক হাজার… তিন হাজার… পাঁচ হাজার। কিন্তু এরপর তো আর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে না। নতুন কাউকে বন্ধু করা যায় না। এখন কী উপায়?

আলবত উপায় আছে। শুধু সেটাকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে চিরুনি অভিযান চালিয়ে খুঁজতে হবে। ফেকলুক থাকবে আর জল্পনা, কল্পনা, গুজব, গুঞ্জন বেশি বেশি ছড়াবে না, তা কী করে হয়!

জল্পনা, কল্পনা, গুজব, গুঞ্জনদের পরিবার একজন সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার নিয়োগ দিল। তিনি এসে বললেন, ‘ঠিক আছে… ঠিক আছে। সব ম্যানেজ করে দিচ্ছি। তোমরা সবাই একটা করে ফেকলুক পেজ খুলে ফেলো। নো চিন্তা ডু ফুর্তি।’

গুজব, গুঞ্জন, জল্পনা, কল্পনা মুহূর্ত দেরি না করে জনপ্রতি একটি করে মোট চারটি ফেকলুক পেজ খুলে ফেলল—

জল্পনার পেজের নাম: জল্প-কল্প

কল্পনার পেজের নাম: কল্প-জল্প

গুজবের পেজের নাম: গুজব নয়, সত্যি

গুঞ্জনের পেজের নাম: গুঞ্জন ফিসফাস

পেজ খুলতে না খুলতেই হু হু করে সবার ফলোয়ার বাড়তে লাগল। খাওয়া নেই, পড়া নেই; সবাই জল্পনা-কল্পনা আর গুজব-গুঞ্জনে বুঁদ। তাদের জীবনটাই হয়ে গেল লাইক আর শেয়ার। মন্তব্যের ঘরেও এখন আর কারও কিছু লেখার টাইম নেই। হলুদ মুখের হা হা, হি হি, রাগ, কান্না দিয়েই পড়িমরি করে আরেক জায়গায় লাইক, শেয়ার দিতে ছোটো।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন কে বা কারা রাজ্য আক্রমণ করে বসল। শত্রু ভয়ংকর। দেখতে যেমনই হোক, আসলে অন্য রকম। যাকে পায়, তাকে খায়। যাকে ধরে, তাকে মারে। সৈন্য-সামন্তরা নেমে গেল শত্রু ঠেকাতে। দুষ্টের দমন যে করেই হোক করতে হবে। তারপর ধরে ধরে মামলা দিতে হবে। আক্রমণের জবাব পাল্টা আক্রমণে। ইটকা জবাব পাত্থরসে।

গোল বাধল অন্য জায়গায়। যাকে পায়, তাকে খায়; যাকে ধরে, তাকে মারে—এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কে পাচ্ছে আর কাকে খাচ্ছে, কে ধরছে আর কাকে মারছে সেটা অন্তত বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু একটা সময়ে দেখা গেল, যাকে পাচ্ছে না, তাকেও নাকি খাচ্ছে! যাকে ধরছে না, তাকেও নাকি মারছে! আবার যাকে পায়, তাকে খায় না। যাকে ধরে, তাকে নাকি মারে না। কে, কখন, কোথায়, কাকে, কীভাবে ধরছে-মারছে-খাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাহলে এখন কী হবে? ‘ফাইভ ডব্লুজ, ওয়ান এইচ’ তো মিলছে না!

সমস্যা সমাধানে রাজ্যসভা বসল এবং এক মিনিটে সমাধান বের হয়ে গেল। সমাধান খুবই সহজ। জল্পনা-কল্পনা ভাসতে থাকুক। গুজব-গুঞ্জন ছড়াতে থাকুক।

ওদিকে জল্পনা-কল্পনা, গুজব-গুঞ্জন খুশিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। উফ, কী আনন্দ! এটাই তো চাই! তাদের ফেকলুক পেজ থেকে সব মুহুর্মুহু শেয়ার হতে লাগল। সেখান থেকে সবখানে। জল্পনা-কল্পনা, গুজব-গুঞ্জন বসে বসে দেখছে আর নাচছে। ফেকলুকে ভাসতে থাকা জল্পনা-কল্পনার ডালপালা থেকে গুজব-গুঞ্জন পাখা ঝাপটে উড়াল দিয়ে রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তাদের চারটি ফেকলুক পেজে হু হু করে লাইক পড়তে লাগল। শেয়ারে শেয়ারে দেশ-দেশান্তরে বিস্তৃত হতে লাগল জল্পনা-কল্পনা, গুজব-গুঞ্জন।

পরিস্থিতি হয়ে গেল আরও ঘোলাটে। চোখে সবাই ঝাপসা দেখতে লাগল। যারা চশমা পরেন, তাদেরও চশমার কাচ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে বিভ্রান্তির কুয়াশায়। রাজ্যের সবার মাথা প্রচণ্ড ব্যথা করতে লাগল। চোখের সমস্যা হলে নাকি মাথা এ রকম ব্যথা করে।

সমস্যা সমাধানে রাজ্যসভা বসল এবং এক মিনিটে সমাধান বের হয়ে গেল। সমাধান খুবই সহজ। জল্পনা-কল্পনা ভাসতে থাকুক। গুজব-গুঞ্জন ছড়াতে থাকুক। আসল সমস্যা যখন মাথায়, মাথা কেটে ফেললেই হলো। যার মাথা ব্যথা, তার মাথা কাটা। মাথা নেই, ব্যথাও নেই।

এরপর মাইকে তা প্রচার হতে লাগল। অলিতে, গলিতে, রাজপথে। সবাই মাইকিং শুনছে আর ফেকলুক, রিউকিউব দেখছে। যদি আরও কিছু জানা যায়, আরও কিছু দেখা যায়। গোপন কোনো ভিডিও। অবিশ্বাস্য কোনো থ্রিল। যদি জেনে নেওয়া যায় ঘটনার আড়ালের ঘটনা।

ব্যতিক্রম শুধু চারজনের একটি পরিবার। তাদের ঘরে ঈদের আনন্দ। অবস্থা দেখে চারজনই মিটিমিটি হাসছে। ডিজিটাল পৃথিবী তবে এভাবেই চলুক। জল্পনা-কল্পনায় ভেসে, গুজব-গুঞ্জনে বিশ্বাস রেখে।

তারেক মাহমুদ, স্পোর্টস এডিটর