শিক্ষাই হোক মেগা প্রকল্প

এম তারিক আহসান
এম তারিক আহসান

বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট, উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং তা অর্জনের জন্য বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ অবকাঠামোগত এবং প্রযুক্তিগত প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেছে। 

ধারাবাহিক সাফল্যের এই ক্ষণে, মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে, এই অবকাঠামো এবং প্রযুক্তি যে মানুষ ব্যবহার করে জীবনের সমস্যা সমাধান করবে কিংবা নতুন নতুন উদ্ভাবন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের সুনাম ছড়িয়ে দেবে যে স্মার্ট বাংলাদেশি নাগরিক, তার মেধা, মনন, মস্তিষ্ক তৈরির কাঠামো, অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা কতটা ভবিষ্যৎ-মুখী হিসেবে তৈরি করতে পেরেছি? 

বাংলাদেশে শিক্ষায় অংশগ্রহণ প্রশংসনীয়ভাবে বেড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার প্রায় ৯৮ শতাংশ এবং শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের তুলনায় কিছুটা বেশি। কিন্তু গুণগতভাবে আমরা আসলে কী অর্জন করছি? সরকারের প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন (২০২২) রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ৫০ শতাংশ বেশি ভাষা ও যোগাযোগ যোগ্যতা এবং দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী গাণিতিক যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। 

জিপিএ-৫ প্রাপ্তির গড্ডলিকাপ্রবাহের মধ্যে দিন শেষে আমাদের সন্তানেরা কী অর্জন করছে? ব্যানবেইসের (২০২২) গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থাৎ প্রাথমিকে ১৪ শতাংশ, মাধ্যমিকে ৩৫.৬৬ শতাংশ ও উচ্চমাধ্যমিক ২১ দশমিক ১৪ শতাংশ পর্যায়ে ঝরে পড়ে। 

গণসাক্ষরতা অভিযানের (২০১৪) গবেষণা বলছে, এই মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হাওয়া সত্ত্বেও কোচিং, গাইড বই এবং প্রাইভেট টিউশনির জন্য অভিভাবকদের বিপুল শিক্ষাব্যয় বহন করতে হচ্ছে। ফলে শহর-গ্রাম এবং ধনী-দরিদ্রের শিক্ষায় অংশগ্রহণ এবং সম্পন্ন করায় বৈষম্য বিরাজ করছে। 

শিক্ষাক্রমের নমনীয়তার অভাবে কোভিড-১৯ মহামারির সময় পৃথিবীর অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশে দীর্ঘদিন শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ ছিল এবং শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন রেকর্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না থাকায় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করতেই হিমশিম খেয়েছি।

ভেবে দেখার বিষয় হলো, ৭০ শতাংশ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীকে অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি হিসেবে বিদেশে পাঠিয়ে বা তৈরি পোশাকশিল্পে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে এবং রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন অষ্টম। অথচ এদের রূপান্তরিত দক্ষতা অর্জন করানো সম্ভব হলে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স আয়ে প্রথম সারির দেশে পরিণত হতে পারত। উন্নত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে এবং বাকিরাও রূপান্তরিত যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে তাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। 

অথচ গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১৭ শতাংশ কারিগরি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে ভর্তি হয়। কাজেই বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশ যে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রোল মডেল হয়েছে, তাতে শিক্ষার অবদান বেশি নাকি সরকারের সুচিন্তিত নেতৃত্বের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফলে বিদ্যমান জনশক্তি ও সীমিত সম্পদের সুনিপুণ ব্যবহারের অবদান বেশি, তা নিবিড়ভাবে ভেবে দেখা জরুরি। 

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমরা প্রচুর মুখস্থনির্ভর পরীক্ষার্থী তৈরি করছি, কিন্তু সমস্যা সমাধানে সক্ষম সৃজনশীল মানুষ তৈরি করছি না। এর ফলে শিক্ষার্থীরা একদিকে তাদের শিক্ষাজীবনে যা মুখস্থ করছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশই কর্মজীবনে এসে ভুলে যাচ্ছে। 

অপর দিকে তারা শুধুই চাকরিপ্রত্যাশী হচ্ছে, উদ্যোক্তা বা আবিষ্কারক হচ্ছে না। ১৭ কোটি মানুষের দেশে আমরা কয়টা মেধাস্বত্ত্বের (পেটেন্ট) অধিকারী? বিশ্ব অর্থনীতির দীর্ঘদিনের বাস্তবতায় উন্নত দেশগুলো একদিকে যেমন মেধা পাচারের মাধ্যমে সারা পৃথিবী থেকে সৃষ্টিশীল মানুষদের নাগরিকত্ব দিয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের মেধাস্বত্ত্ব তৈরির ঝুলি ভারী করেছে, তেমনি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে মেধাস্বত্ত্ব তৈরিতে সক্ষম সৃজনশীল মানুষ তৈরির প্রক্রিয়াও অব্যাহত রেখেছে। এমনকি কোভিড-১৯-এর মন্দার সময় যে দেশগুলো টিকা আবিষ্কার করেছে, তাদের অর্থনীতি চাঙা হয়ে গিয়েছিল। 

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩-এর জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট সনদধারী বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ৮২ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কর্মহীন থাকছে প্রায় ৮ লাখ তরুণ। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন এই তথ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় ভর্তি এবং অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পরও এই সনদসর্বস্ব মুখস্থনির্ভর শিক্ষা মডেল দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম মানুষ তৈরি করতে যেমন পারছে না; সৃষ্টিশীল মানুষ তৈরির মাধ্যমে জ্ঞাননির্ভর সমাজ গঠনেও ব্যর্থ হচ্ছে। আর মূল্যবোধ অর্জনের বিষয়টি বর্তমান শিক্ষা মডেলে সবচেয়ে অবহেলিত, দেশপ্রেম, সহযোগিতা—এসবও শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে এবং লিখে প্রকাশ করে শেখে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে ‘শ্রমভিত্তিক মডেল’ অবলম্বন করে বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে, তা অচিরেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তির প্রসারের ফলে নতুন অনেক কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, যার কারণে বর্তমানের অনেক পেশা ও শ্রম অচিরেই প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। ফলে চাকরির নিয়োগপ্রক্রিয়ায়ও রূপান্তর ঘটছে। চাকরিক্ষেত্র এখন আর সনদ বা নম্বর দেখার পরিবর্তে পারদর্শিতা দেখছে। দেশের তরুণেরা যারা ফ্রিল্যান্সিং করছে তাদের পারদর্শিতার প্রমাণ দিয়েই কাজ পাচ্ছে, জিপিএ বা সনদ দেখিয়ে নয়। 

উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বৈশ্বিক চাহিদা বিবেচনা করে নিজেদের রূপান্তর ঘটাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো ক্যাম্পাস/কোর্স/মডালিটি বাছাই করে কোর্স ডিজাইন করছে। পূর্বজ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে কোর্সের সময়সীমা ঠিক করছে। 

এমনকি বর্তমান কাজে সম্পৃক্ত থেকেই অ্যাসাইনমেন্ট নির্ধারণের সুযোগ পাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণে সার্বিক শিক্ষাকাঠামো হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিনির্ভর। বৈশ্বিক রূপান্তরের ধারায় পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি দেশ শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তর ঘটাচ্ছে। আমরা এমন একটি যুগে প্রবেশ করেছি, যখন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী শিক্ষায় ভর্তি-শিখনপ্রক্রিয়া-মূল্যায়ন, চাকরি প্রাপ্তির বিধি, পেশার ধরন, উৎপাদনক্ষম মানুষের বৈশিষ্ট্য সব পাল্টে যাচ্ছে। 

২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশও বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায়ও রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের প্রাক্​প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। 

আমরা জানি, এই পরিবর্তন আনতে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে বর্তমান পৃথিবীতে লেখাপড়া আর আধেয় মুখস্থ করা নয়, কাজেই শিখন উপকরণ কেবল পাঠ্যবই নয়। এর সঙ্গে গতানুগতিক মুখস্থনির্ভর পেপার-পেনসিলভিত্তিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার চর্চা কমিয়ে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা পরিমাপের উদ্দেশ্যে মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। 

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমরা প্রচুর মুখস্থনির্ভর পরীক্ষার্থী তৈরি করছি, কিন্তু সমস্যা সমাধানে সক্ষম সৃজনশীল মানুষ তৈরি করছি না

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক গবেষণার মান উন্নয়ন জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক প্রশাসনিক, একাডেমিক ব্যবস্থাপনার অটোমেশন এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা নিয়ে গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে বের করার জন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের সচেতনতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির তাগিদও রয়েছে। সার্বিক এই শিক্ষাকাঠামো রূপান্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শিক্ষক। কাজেই পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য প্রাক্​যোগ্যতা নির্ধারণ, প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, বেতনকাঠামো, পেশাগত উন্নয়নপ্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজাতে হবে। 

সার্বিক এই শিক্ষা রূপান্তরকে নিশ্চিত করার জন্য যে পদক্ষেপটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং বিদ্যমান সম্পদের স্মার্ট ব্যবহার। বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ভিশন-২০৪১ অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে শিক্ষায় জিডিপির বরাদ্দ ২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি সাপেক্ষে ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পাবে। 

কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, আজকে যে শিশুটি বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হলো, সে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশের ২৪ বছরের টগবগে সৃষ্টিশীল স্মার্ট তরুণ। কাজেই শিক্ষার রূপান্তরপ্রক্রিয়া বাস্তবায়নের যে কাজ শুরু হয়েছে, তা একটি দিনও থামিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। তার ওপরে বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বেশির ভাগ তরুণ, যার জনমিতিক সুফল পেতে অবিলম্বে রূপান্তরযোগ্য দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন, তা না হলে ২০৩৫ সালের পরেই প্রবীণদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। 

কাজেই অবিলম্বে স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির লক্ষ্যে শিক্ষার রূপান্তরের ধারা নিশ্চিত করে স্মার্ট, অভিযোজনে সক্ষম, মানবিক চেতনার দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরির কোনো বিকল্প নেই। এই উন্নয়নধারায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে যেমন বিকল্প বরাদ্দ জোগান দেওয়ার ফলে অনেক মেগা প্রকল্প সফলভাবে দৃশ্যমান, তেমনি জিডিপির বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনার বাইরে শিক্ষায় এখন বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। কাজেই শিক্ষাই হোক বাংলাদেশের নিকট ভবিষ্যতের
মেগা প্রকল্প! 

এম তারিক আহসান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক।