মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা: বিজ্ঞানের কুদরত

জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।

মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা (১ ডিসেম্বর ১৯০০—৩ নভেম্বর ১৯৭৭)

ছোটবেলা থেকেই ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদার নাম শুনেছি, আমাদের পাঠ্যবইতেও তাঁর কথা ছিল। প্রথম মুসলিম ডক্টরেট, কৃতী ছাত্র, প্রথিতযশা রসায়নবিদ ইত্যাদি। এরপর ১৯৯১-এর সেপ্টেম্বরে হঠাৎ হাতে আসে বঙ্গবাসী কলেজের লাডলিমোহন মিত্রের রসায়নশাস্ত্রের বিখ্যাত পাঠ্যবই আ টেক্সটবুক অব ইনরগানিক কেমিস্ট্রি (১৯২৪)। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে দীর্ঘকাল এটি ছিল অজৈব রসায়নের একচেটিয়া পাঠ্যপুস্তক। এই বইয়ের ১৯৩৩ সংস্করণের মুখবন্ধে ড. খুদাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে প্রশস্তি লেখা অংশটুকু আমার নজর কাড়ে। সেখানে লেখা, তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপাল। সেই বিশ শতকের তিরিশের দশকে অমন গুরুত্বপূর্ণ একটা কলেজের অধ্যক্ষ একজন মুসলিম, এটা একটা বিরাট অর্জন। 

ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদার জন্ম বীরভূম জেলার মাড়গ্রামে। তাঁর জীবন ও কর্ম বিশ শতকের একটা আদর্শ নমুনা। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণা বিশ শতকের প্রথম দিককার নির্যাসে ভরা। তাঁর প্রস্তুতির সময়টা দেখলে আমরা সেটা বুঝতে পারব—কলকাতার মাদ্রাসা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ১৯১৮ সালে, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এমএসসি ১৯২৫ সালে, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ১৯২৯ সালে। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ঃপ্রাপ্তি বিশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে। তখন পদার্থবিজ্ঞানে চলছে নতুন বিপ্লব, রসায়নশাস্ত্রেও এসে লেগেছে তার ঢেউ। কুদরাত-এ-খুদার আগাগোড়া পছন্দের বিষয় কেমিস্ট্রি, বিশেষ করে জৈব রসায়ন। ডক্টরেটের জন্য কার্বোহাইড্রেটের রিং চেইন টটোমারিজম নিয়ে কাজ করেছিলেন। পরে দেশে এসেও বিবিধ দেশীয় রাসায়নিক গবেষণা করেছেন। পাটের ওপর ক্ষারের বিক্রিয়া নিয়ে তাঁর কাজ (১৯৬৪) বিখ্যাত হয়ে আছে। যাহোক, দেশে ফিরে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন বিভাগে যোগদান করেন, প্রভাষক হিসেবে ১৯৩১ সালে। ১৯৩৬ সালে হন বিভাগীয় প্রধান। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রিন্সিপাল পদে থাকেন বেশ কয়েক বছর। 

দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন ড. কুদরাত-এ-খুদা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ না দিয়ে তিনি ডিপিআই বিভাগে যোগদান করলেন। হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর মতদ্বৈততা ছিল।

‘জনশিক্ষা দপ্তরের পরিচালকের পদে থাকার সময় সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না, কেননা স্কুলে উর্দু শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে তিনি মতপ্রকাশ করেন। ১৯৫০ সালে তাঁকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান উপদেষ্টা করা হয়, কিন্তু করাচিতেও তাঁর জীবন আনন্দময় ছিল না। একসময় তাঁর গৃহে রাতে ইটপাটকেল পড়া শুরু হলো, করাচিতে বাস করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান
মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন, যা তাঁর জন্য মোটেই উপযুক্ত পদ ছিল না।’ (এ এম হারুন-অর-রশীদ, ‘উপমহাদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানী’)

১৯৫৩ সালে পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ গঠিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত হলো দেশীয় সম্পদের বিকাশে পশ্চিম ও পূর্বে কয়েকটি গবেষণাগার গড়ে তোলা হবে। ১৯৫৫ সালে পূর্বাঞ্চলীয় গবেষণাগার গড়ে তোলার দায়িত্ব পান ড. খুদা। এই প্রতিষ্ঠানটিরই উত্তরসূরি আজকের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। ড. খুদা একদম শূন্য থেকে তিল তিল করে এটি গড়ে তোলেন। বিদেশে অর্জিত অভিজ্ঞতার অনেকখানিই তিনি সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে। ১৯৬৬ সালে অবসরের আগপর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম থেকেই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় স্বাধীনতা ছিল। কাজ করার মুক্ত পরিবেশ ছিল।

বাংলার শিল্পায়নকে ঘিরে ড. খুদার অনেক চিন্তাভাবনা ও পরিশ্রম ছিল। তাঁর শিল্পভাবনা নিয়ে বিশদে লিখেছেন ড. আলী আসগর:

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ক্রমবর্ধমান বৃহৎ জনসংখ্যা, কর্মহীনতা, সব রকম পণ্যের জন্য পরনির্ভরতা, অপুষ্টি, অশিক্ষা, অপচয়, অসহায়ত্ব—সবকিছুরই একটিমাত্র সম্ভাব্য সমাধান, সমাধান না-হোক তার মোকাবিলা করার পথ হলো, এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে শিল্পজাত দ্রব্যে রূপান্তরিত করা।...তিনি দেশীয় সম্পদনির্ভর শিল্পকারখানা নির্মাণের কথা ভেবেছেন। কিন্তু কুটিরশিল্পকে বৃহৎ আধুনিক শিল্পের বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করেননি।...তিনি শিল্পকে দেখেছেন ক্রম–উন্নয়নশীল প্রযুক্তিবিজ্ঞান হিসেবে। যার লক্ষ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি। ...তাঁর গবেষণা চিন্তার মধ্যে ছিল নিম তেলের উপাদানগুলোর পৃথকীকরণ। মাছের সংরক্ষণ ও মাছে উপস্থিত খাদ্য উপাদানগুলোর বিশ্লেষণ ও পরিমাপ, জৈব রাসায়নিক ও পুষ্টিসম্পর্কিত গবেষণা, নারকেল নিয়ে গবেষণা, সাদা মুলায় এসকরবিক অ্যাসিডের বিন্যাস, শর্করাজাতীয় শস্যের প্রতিকল্প নিয়ে আলোচনা, ফল ও ফল থেকে উৎপন্ন খাবার নিয়ে গবেষণা এবং শিল্পজাত খাদ্য তৈরিতে এদের ব্যবহার। বাংলাদেশের কলার ওপর জৈব রাসায়নিক ও পুষ্টিসম্পর্কিত গবেষণা। চালের ওপর ফটোমাইক্রোগ্রাফিক পর্যবেক্ষণ। দেশীয় নানা খাদ্যশস্য নিয়ে গবেষণা, দেশীয় কাঠের রাসায়নিক বিশ্লেষণ, বাংলাদেশের ক্লে মাটির ওপর গবেষণা। পাটখড়ি, সিলেটের গ্যাস, ফরিদপুরের পিট কয়লা নিয়ে গবেষণা। (আলী আসগর, কুদরাত-এ-খুদা: বিজ্ঞানচর্চার আয়োজনে, সূচীপত্র, ২০১৭)

পাটখড়ি থেকে কাগজের মণ্ড তৈরির উপায় বাতলে দিয়ে তিনি প্রভূত উপকার করেছিলেন। পাটখড়ি থেকে নাইলন তৈরির একটি উপায়ও তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন।

অপর যে অবদানটির জন্য আজও তিনি স্মরণীয়, সেটি হলো ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন। ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে সরকার। প্রায় এক মাস ভারত ঘুরে সেখানকার শিক্ষা নিয়ে সরেজমিনে জেনেশুনে আসে কমিশন। জনশিক্ষা নিয়ে খুদার অভিজ্ঞতা, অন্যান্য বহু মতামত ও ব্যাপকভিত্তিক অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ, সংযোজন এবং সংশ্লেষণের পর ১৯৭৩ সালের ৮ জুন প্রায় ৪৫০ পাতার রিপোর্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পেশ করে শিক্ষা কমিশন।

এটি স্বাধীন দেশের প্রথম এবং আমার মতে অদ্যাবধি সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষা রিপোর্ট। এতে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় অন্তত ২৫ শতাংশে উন্নীত করা, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও বিনা মূল্যে করা, শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা প্রবর্তন, বিজ্ঞান ও কৃষিশিক্ষাকে বিশেষ স্থান দেওয়া, কারিগরি ও প্রকৌশলশিক্ষাকে সম্প্রসারণ করা, জনশক্তি কমিশন গঠন, শিক্ষক হিসেবে যোগ্যতমদের নিয়োগ এবং সে জন্য তাঁদের বেতনকাঠামোকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করার প্রস্তাব করা হয়। ‘কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই রিপোর্ট বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ মেলেনি। অর্থনৈতিক সংকট, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অভাব এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, স্বাধীনতার সব প্রত্যাশাকে যেন স্তব্ধ করে দিল, লিখেছিলেন ড. আলী আসগর।

কুদরাত-এ-খুদা একদম শূন্য থেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন আজকের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)

ড. মুহাম্মাদ কুদরত-এ-খুদার আরেকটি অবদান, মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরা এবং তদনুযায়ী বিজ্ঞানবিষয়ক জনবোধ্য এবং পাঠ্যপুস্তক রচনা। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর নিখাদ ভালোবাসার মূলে ছিল স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতা, যেখানে উর্দু ভাষায় পড়ানো হতো। বাংলাভাষী আর উর্দুভাষীদের মধ্যে নিয়মিত টক্কর লাগত। তদুপরি ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রভাব। পাকিস্তান আমলেও এ জন্য তিনি সরকারি রোষানলে পড়েছেন, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকেও তাঁকে বিতাড়িত করা হয়।

১৯৩৬ সালে তিনি লিখেছিলেন বাংলার মাধ্যমে বিজ্ঞান। এরপর তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী। আমার মতে, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা-কীর্তি চার খণ্ডের জৈব রসায়ন, ১৯৭১ সালে যার চতুর্থ খণ্ড প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। নব্বই দশকেও আমি এর প্রথম খণ্ডটিকে ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করতে দেখেছি। ১৯৭৩ সালে তিনি রচনা করেন কলেজ কিমিয়ার কথা। তবে ড. খুদা যে পরিভাষা ব্যবহার করতেন, তা এত খটোমটো ছিল যে একালের পাঠকের কাছে তাঁর ব্যবহৃত বাংলা শব্দগুলোর কিছুই বোধগম্য হবে না। মৃদাঙ্গার তাকতীরণ, সুরভিচাক্রিক উদ্​যান, অম্লজান, যবক্ষারজান—এমন শব্দ কে বুঝবে? কিন্তু পথিকৃৎ হিসেবে ড. খুদা তাঁর কাজটি করে গেছেন। 

আজীবন বিজ্ঞানসাধনা করেছেন, বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে বিজ্ঞানের বই রচনা করে গেছেন, রসায়নের গবেষণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গেছেন, নবীন একটি রাষ্ট্রের জন্য তৈরি করে দিয়েছেন একটি শিক্ষানীতি; ছিলেন ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট, প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তিধারী; সর্বোপরি কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন একজন আধুনিকমনা মানুষ। একজীবনে আর কী চাই? 

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী: বিজ্ঞান–লেখক; অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়