চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড় এলাকায় পুলিশের টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের মুখে শিক্ষার্থীদের এলোপাতাড়ি ছোটাছুটি। ২৯ জুলাই ২০২৪
চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড় এলাকায় পুলিশের টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের মুখে শিক্ষার্থীদের এলোপাতাড়ি ছোটাছুটি। ২৯ জুলাই ২০২৪

সমতা ও আত্মমর্যাদার আন্দোলনে

শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ও ফরহাদ আমার বিভাগের অনুজ। তাদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দুজন শহীদ হয়েছে, তারা উভয়েই ইতিহাস বিভাগের। এমন হাজার শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আজকের নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। আমরা বায়ান্ন, একাত্তর ও নব্বই দেখিনি, কিন্তু চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান দেখেছি। এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তের মুখোমুখি হওয়া সৌভাগ্যের।

আমি আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলাম ৯ জুলাই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের এক সমাবেশে। এর আগে চট্টগ্রাম শহরে ব্যাপক পুলিশি বাধার মুখে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালিত হচ্ছিল। নতুন করে ক্যাম্পাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণসংযোগ কর্মসূচিও ছিল। আগে আন্দোলনে যুক্ত না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, শুরুতেই আন্দোলনটি ছিল পুরোপুরি কোটা বাতিলের ইস্যুকেন্দ্রিক। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সন্তান হিসেবে কোটা বাতিলের যৌক্তিকতা নিয়ে দ্বিধা কাজ করছিল আমার মধ্যে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন হয়েছিল, তখন ক্যাম্পাসে আমরা ছিলাম নবাগত। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা পুনর্বহাল রাখা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু সরকার কোটা বাতিল করেছিল। এই বাতিলের পর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল জাতিগত সংখ্যালঘু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা।

ক্যাম্পাসে আন্দোলনের শুরুতে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত রাফির সঙ্গে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলোর জন্য বরাদ্দ কোটা পুরোপুরি বাতিলের বিষয় নিয়ে আলাপ করেছিলাম, কিন্তু যৌক্তিক কোনো সদুত্তর পাইনি। পরে সমমনা বন্ধুবান্ধবেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিই, ছাত্র আন্দোলনকে আমরা পর্যবেক্ষণ করব এবং যৌক্তিক হলে সমর্থন করব। এর মধ্যে গণসংযোগ ও কর্মসূচি চলতে থাকল। একপর্যায়ে আন্দোলন যখন তীব্র হতে থাকে, তখন আমাদের সমমনারা সামনের সারিতে চলে আসে এবং বৈষম্যবিরোধী ব্যানারে সবাই যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

১৪ জুলাই স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলার প্রতিবাদে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্টে রাতে এসে জড়ো হয়। তখন আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ। পরদিন ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ কর্তৃক বিকেলের শাটল ট্রেন আটকে রেখে সমন্বয়ক তালাত রাফিকে মারধরসহ জোর করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় আন্দোলনকারীদেরও করা হয় মারধর। প্রক্টর অফিসে রাফিদের সঙ্গে নারী শিক্ষার্থীরাও ছিল। তাদের খোঁজ নেওয়ার জন্য আমরা ওই কার্যালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগের লোকজন আমাকে হেনস্তা করে এবং সঙ্গে থাকা সহযোদ্ধা জাকিরকে মারধর করে। রাফির সঙ্গে থাকা নারী শিক্ষার্থীদের আমরা বারবার যোগাযোগ করে জানাচ্ছিলাম, যেভাবেই হোক রাফিকে নিরাপদ রাখতে হবে, ছাত্রলীগের সামনে তাকে একা ছাড়া যাবে না। সেদিন প্রক্টর অফিসে রাফির সঙ্গে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ঈশা দে ও সুমাইয়ারা। রাফি তত দিনে চট্টগ্রামে আন্দোলনের পরিচিত মুখ। নেতৃত্বকে রক্ষা করা ছিল আমাদের লক্ষ্য। পরে শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে রাফিকে শহরে পৌঁছে দিতে বাধ্য হয় প্রশাসন।

রোনাল চাকমা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী

পরদিন ১৬ জুলাই নিরাপত্তার কারণে ক্যাম্পাস থেকে কয়েক ভাগে শহরের মুরাদপুরের কর্মসূচিতে গিয়েছিলাম। আমি পাহাড়ি হওয়ায় পর্যবেক্ষণ করার সুবিধার্থে ষোলশহর, মেয়র গলি ও ২ নম্বর গেট ঘুরে এসেছিলাম। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ছিল দেশি-বিদেশি অস্ত্রে সজ্জিত। পুলিশ প্রথম দিকে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করা দেখত পরে যখন ওই সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পেরে উঠত না, তখন তাদের শেলটার দিত পুলিশ। একসময় সবাই মুরাদপুরের মোড়ে জড়ো হলাম। মুরাদপুর মোড়ে তখন শিক্ষার্থী-জনতায় লোকারণ্য।

এদিন মোড় থেকে ২ নম্বর গেটের দিকে শিক্ষার্থী-জনতা আওয়ামী লীগ আর পুলিশকে ধাওয়া করে নিয়ে যায়, আবার কিছুক্ষণ পর পুলিশ ও আওয়ামী লীগ মিলে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে নিয়ে আসে। আমি আর আমার সহযোদ্ধা কয়েকজন ইট-লাঠি নিয়ে এভাবে বেশ পাঁচ-ছয়বার পাল্টাপাল্টি ধাওয়া করলাম। তার মধ্যে চোখের সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে কয়েক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, আমাদের সামনে যারা গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, তাদের মধ্যে মো.ওয়াসিম (২২) ও মো. ফারুক (৩২) নামের দুজন শহীদ হয়েছে। এখনো ওই ঘটনা শরীরে শিহরণ জাগায়। সামনের কাঁধে গুলি ঝাঁঝরা করে পেছন দিক দিয়ে বের হয়েছে। সেদিন আমাদেরও এমন পরিণতি হতে পারত। আমি পায়ের গোড়ালিতে ইটের আঘাত পেয়েছিলাম।

কর্মসূচি শেষ করে সবাই ক্যাম্পাসে ফিরলাম। পরদিন দুপুরে যখন বের হচ্ছি, তখন আন্দোলনের চবি (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) সহসমন্বয়ক ধ্রুব বড়ুয়াও বের হলো। উদ্দেশ্য ছিল নারীদের হলের দিকে যাওয়া। কারণ, নারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছাড়তে চাচ্ছিল না। ১৭ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ক্যাম্পাসের ২ নম্বর গেটে বের হওয়ামাত্র ধ্রুবকে ছাত্রলীগের ৪০-৫০ জন ঘিরে ধরে ‘শিবির’ বলে মারধর শুরু করে। তার ফোন কেড়ে নেয়। আমি খানিকটা দূরে ছিলাম, একা। এমন অসহায় লাগছিল, মনে হচ্ছিল, নিজের সহযোদ্ধাকে রক্ষা করতে পারছি না! এই অবস্থায় সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি প্রক্টরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জানালাম। পরে প্রক্টর নিজের জিম্মায় ধ্রুবর ফোন রেখে দিয়ে ছেড়ে দিলেন তাকে। 

পরদিন ১৮ জুলাই দুপুরে ক্যাম্পাস থেকে নিরাপদ জায়গায় ধ্রুবকে এগিয়ে দিলাম। যারা গ্রেপ্তার আতঙ্কের মধ্যে ছিল, তাদের খোঁজ নিচ্ছিলাম। পরিচিত অনেকেই মেস ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। ছাত্রলীগ আর পুলিশ মিলে তখন ক্যাম্পাসের মেসগুলো তল্লাশি এবং শিক্ষার্থীদের বাড়ি ফেরার জন্য চাপ দিচ্ছিল। হৃদয় তরুয়া সেদিন টিউশন থেকে ফেরার পথে শহরে গুলিবিদ্ধ হয়।

এরপর ১৯ জুলাই, আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। ঢাকাসহ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে গণহত্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হলো। এ সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেল। তার আগেই আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ শত শত প্রাণ ঝরে গেল নিমেষেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও প্রতিবাদে নামলেন। সমন্বয়কদের জিম্মি করেও আন্দোলন থামানো গেল না। সব শ্রেণি–পেশার মানুষ নেমে এল রাজপথে। সর্বত্র গড়ে উঠল প্রতিরোধ।

চট্টগ্রামের সর্বশেষ কর্মসূচি ছিল ৪ আগস্ট। সেদিন নিউমার্কেটের কর্মসূচিতে পুলিশ আর আওয়ামী লীগ যৌথভাবে হামলা করে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করেছিল। ওয়াসা মোড়ে গিয়ে জড়ো হলাম আমরা। পথে পথে তখন সেনাদের টহল। পুলিশ ব্যারাকে আটকা পড়া শিক্ষার্থীরা ওয়াসার মোড়ে জড়ো হচ্ছিল। পরে সমাবেশ শুরু হলো। 

চট্টগ্রাম তখন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। আমার সঙ্গে ছিল চট্টগ্রাম শহরের মংপ্রুসাইন মারমা। বিকেলের মধ্যে ঢাকা থেকে ঘোষণা এল, আগামীকাল ৫ আগস্ট লংমার্চ টু ঢাকা। ক্যাম্পাসে ফিরে ঢাকায় যাওয়া নিয়ে কথাবার্তা হলো, কিন্তু যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো না। আমরা চট্টগ্রামে ছিলাম। তাই ৫ আগস্টের ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গণভবনে যেতে না পারার আক্ষেপ রয়েই গেল। 

চট্টগ্রাম শহরে একের পর এক বিজয় মিছিল, আমাদের ক্যাম্পাসেও তখন সবার উৎসুক দৃষ্টি, স্বস্তি ও উল্লাস; যেন জগদ্দল পাথর চেপে বসা বুক থেকে সরানো গেল। পরিচিতজনের হাসিমাখা মুখে জাতীয় পতাকা নিয়ে বাইরে উল্লাসরত—কী এক দিন!

অনেকেই প্রশ্ন করে, আন্দোলনে জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কিন্তু আমি এমন অনেককেই দেখেছি, যারা আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ, আহত হয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা রেজিমের সময় সবচেয়ে নিপীড়নের শিকার ছিল জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। জোরপূর্বক ভূমি বেদখল, মন্দির-প্রতিমা ভাঙা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু করে নারী ধর্ষণ—কোনো ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বৈষম্য ও অধিকার–বঞ্চনাবোধ ছিল। ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতি নিয়ে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও বহু বিদ্রূপ ও উপহাসের শিকার হতে হয়েছে। সবার অংশগ্রহণ নতুন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম আমরাও। আমরা হয়তো আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড কিংবা প্রধান শক্তি ছিলাম না। কিন্তু মহাসিন্ধুতে এক বিন্দু জল ফেলার মতন আমরাও ছিলাম এখানে। দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ আমাদের তাড়িত করেছে। দেশের সংকটে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারিনি আমরা; একাত্তরের প্রথম মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে আমাদের অগ্রজরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন।

গণ–অভ্যুত্থানের পর আমি এমন দেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে আমার আত্মপরিচয় স্বীকৃত থাকবে, সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও আমার ভূমি থাকবে দখলমুক্ত, যেখানে আমার সহোদরেরা মুক্ত পাখির ডানা মেলে নিরাপদে বড় হবে, সমতা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে কেউ কাউকে ছোট করবে না, দেশের প্রতিটি অর্জনে থাকবে সবার সমান প্রচেষ্টা ও অবদান। নতুন বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির দেশ হয়ে উঠুক।

* রোনাল চাকমা: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী