মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্পদে অপ্রতুল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে। কিন্তু নিন্দুকদের আশঙ্কা অসত্য প্রমাণ করে একের পর এক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এই এগিয়ে যাওয়ার পথ রচিত হয়েছিল কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা, অভিনব ভাবনা, ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগে। আমরা ফিরে দেখছি বাংলাদেশের উজ্জ্বল সেসব মুহূর্ত।
উদ্ভাবনী অভিনবত্বের ধারণা এখন বিশ্বজুড়ে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। আমরা যখনই এ শব্দ শুনি, তখনই অনেকে অবচেতনে ভেবে নিই ঝাঁ–চকচকে প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের কোনো সমস্যার চমকপ্রদ সমাধানের গল্প। বাস্তবতা ভিন্ন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নাল ল্যানসেট–এর মতে, বিংশ শতাব্দীর চিকিৎসাক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সাফল্য যে ইনোভেশন বা উদ্ভাবন থেকে এসেছে, তা মোটেও উচ্চ প্রযুক্তির কিছু নয়, চমকপ্রদ তো নয়ই!
খাওয়ার স্যালাইন মূলত চিনি-লবণের অতি সাধারণ দ্রবণ। ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা, যে কারণেই হোক না কেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটা অন্ত্রে পানির নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয়। এ কারণে দেহে পানির পরিমাণ কমে যেতে থাকে। সঙ্গে দেহ হারাতে থাকে পানিতে দ্রবীভূত বিভিন্ন পদার্থ। সোডিয়াম আয়ন তার মধ্যে একটি, যা একটা নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নেমে গেলে স্নায়ুতন্ত্র কাজ করতে পারে না। আর পানির অভাবে শরীরের প্রায় সব শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। পানি ও সোডিয়াম আয়নের মাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক না হলে কিডনি, মস্তিষ্কসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ নষ্ট হতে শুরু করে। মৃত্যুও হতে পারে। তবে কলেরাসহ বিভিন্ন জীবাণুঘটিত ডায়রিয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্ত্রে পানি শোষণের প্রক্রিয়াটি খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তাই বেশি বেশি তরল খেলে উপকার পাওয়ার কথা।
এ গবেষণায় যে রোগীরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের কেউই ডায়রিয়ার মারা যাননি। তারপরও অনেক চিকিৎসক এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। অবশ্য একেবারে অকারণে নয়।
কিন্তু ডায়রিয়ার চিকিৎসা হিসেবে শুধু পানি পান করলে লাভ হয় না। কারণ, এতে সোডিয়ামের ঘাটতি মেটে না। তাহলে লবণ-পানি খেলে সমস্যার সমাধান হওয়ার কথা, যেহেতু খাওয়ার লবণ মূলত সোডিয়াম ক্লোরাইড। কিন্তু তাতেও উপকার পাওয়া যায় না; বরং দেহ আরও পানিশূন্য হতে থাকে। কেননা, অন্ত্রে শুধু লবণ-পানি ভালোভাবে শোষিত হতে পারে না। সঙ্গে গ্লুকোজ দরকার হয়। এ তথ্য ষাটের দশক থেকে বিজ্ঞানীদের জানা ছিল। কিন্তু পানিশূন্যতার চিকিৎসায় দু–একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এ তথ্য কাজে লাগানোর নজির ছিল না। ডায়রিয়াজনিত বা অন্য কোনো কারণে পানি ও লবণের ঘাটতি হলে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়াই ছিল একমাত্র চিকিৎসা। সত্তরের দশকে ঢাকায় দুই মার্কিন চিকিৎসক ডেভিড ন্যালিন ও রিচার্ড ক্যাশের তত্ত্বাবধানে বিশ্বে প্রথমবারের মতো ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতার চিকিৎসায় খাওয়ার স্যালাইনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয় মাত্র ২৯ জন রোগীর ওপর। তৎকালীন কলেরা রিসার্চ সেন্টারে (বর্তমানে আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা যায়, লবণ-চিনির একটি বিশেষ দ্রবণ পান করলে পানিশূন্যতার উপশম হতে পারে। এমনকি শিরাপথে স্যালাইন প্রয়োগ না করলেও রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ গবেষণায় যে রোগীরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের কেউই ডায়রিয়ার মারা যাননি। তারপরও অনেক চিকিৎসক এ ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। অবশ্য একেবারে অকারণে নয়।
এ কারণেই চিকিৎসকেরা ডায়রিয়ার চিকিৎসায় রোগীর মুখে খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ রেখে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়াটাই বরং প্রাধান্য দিতেন।
শিরাপথে স্যালাইন দিতে যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, সেই বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরু থেকে, তার একেবারে মৌলিক সংস্করণেও চিকিৎসকের বেশ নিয়ন্ত্রণ থাকে কতখানি তরল রক্তে প্রবেশ করানো হচ্ছে, তার ওপর। মিলিলিটারের ভগ্নাংশ পরিমাণ তরল চুলচেরা হিসাব করে মিনিটপ্রতি মাপে রোগীকে দেওয়া যায়। বেশি হলেও বিপদ, কম হলেও সমস্যা। খাওয়ার স্যালাইনে সেই সূক্ষ্মতা নেই। তার ওপর ডায়রিয়ার রোগীর পেটে কিছু পড়লে এমনিতেই তাঁর অস্বস্তি হয়। দ্রুতই তা পরিপাকতন্ত্রের অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যায় প্রায় অপরিবর্তিত রূপে। তার ওপর যদি বমি হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তা ছাড়া খাওয়ার স্যালাইনে চিনি, লবণ ও অন্যান্য উপাদান চুলচেরা মাপে মিশিয়ে রোগী বা তার অচিকিৎসক স্বজন সঠিক নিয়মে ব্যবহার করতে পারবেন, এটা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার মনে করা হতো। মাপের তারতম্য হলে, যেমন লবণ বেশি হয়ে গেলে, রোগী আরও বেশি পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে। সে সময় যে দ্বিধা কাজ করছিল, তা ছিল এ রকম—ধরা যাক, সব মাপ ও নিয়ম মেনে খাওয়ার স্যালাইন প্রস্তুত করা হলো। পেটের অস্বস্তি বা বমি হলেও রোগী তা ক্রমাগত পান করতে থাকলেন। তাত্ত্বিক হিসাবে দৈনিক গড়ে ১০ থেকে ২০ লিটার পানি পান করতে বলা হয়। ফলে পানি ও লবণের ঘাটতি পূরণের জন্য কার্যক্ষেত্রে রোগীর বেলায় সেটা আদৌ সম্ভব কি না, বলা যাচ্ছিল না। এ কারণেই চিকিৎসকেরা ডায়রিয়ার চিকিৎসায় রোগীর মুখে খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ রেখে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়াটাই বরং প্রাধান্য দিতেন।
সব হিসাব উল্টে গেল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোয়। তখন ভারতের বনগাঁয় বাংলাদেশ থেকে বহু শরণার্থীর গা-ঘেঁষাঘেঁষি ভিড়। তুমুল বর্ষণ। খাবারের অভাব। পানীয় জলের অভাব। নিরাপদ টয়লেটের অভাব। সব মিলিয়ে শরণার্থীশিবিরে শুরু হলো কলেরা মহামারি। দিনে গড়ে ১০ জন করে মানুষ মারা যাচ্ছেন। কারণ, পানিশূন্যতা। সব কাজ ফেলে কলকাতা থেকে ছুটে গেলেন চিকিৎসক দিলীপ মহলানবীশ। তিনি তখন কলকাতায় জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মেডিকেল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ে কর্মরত। তিনি ও তাঁর দল বনগাঁয়ের শরণার্থীশিবিরে গিয়ে দেখে, কলেরা রোগীর সংখ্যা এত বেশি, সেখানে তাঁবু খাটিয়ে যে অস্থায়ী হাসপাতালের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তার শয্যাসংখ্যা ও স্থান পাঁচ গুণ বৃদ্ধি করার পরও মেঝে ও মাটিতে তিল ধারণের জায়গা হচ্ছে না। প্রায় সাড়ে তিন লাখ শরণার্থীর মধ্যে হাজারে হাজারে কলেরা রোগী। মহলানবীশের দলে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়ার প্রশিক্ষণ ছিল মাত্র দুজনের। সেই স্যালাইনও প্রায় শেষের পথে। আর কোনো উপায় না দেখে তিনি ন্যালিন-ক্যাশের সেই কলেরা ট্রায়ালে ব্যবহৃত ‘ঢাকা সলিউশন’ প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
মহলানবীশের সহকারীরা বড় বড় ড্রামে ‘ঢাকা সলিউশন’ তথা খাওয়ার স্যালাইন বানাতে শুরু করেন। লাইন ধরে কলেরায় আক্রান্ত শরণার্থীদের তা খাওয়ানো হতে থাকে। অবশ্য যাঁদের ক্ষেত্রে তীব্র পানিশূন্যতা ছিল, তাঁদের বেলায় যত দূর সম্ভব শিরাপথে স্যালাইন দেওয়ার চেষ্টা ছিল। সে সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। সপ্তাহ না ঘুরতেই মৃত্যুহার, আক্রান্তের ৩০ শতাংশ থেকে একধাক্কায় ৩ শতাংশে নেমে আসে। এ সাফল্যের কথা প্রচারিত হতে বেশি সময় লাগে না। তারপর যে এই চিকিৎসাপদ্ধতি খুব দ্রুত বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল, তা নয়। সে আরেক কাহিনি।
মহলানবীশের মহান উদ্যোগের পর প্রায় এক দশক কেটে গেছে তত দিনে। ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতা তখনো পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর এক নম্বর কারণ। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে; বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার স্বল্পোন্নত দেশগুলোয়। আশির দশকে বাংলাদেশি একটি অলাভজনক সংস্থা ব্র্যাক উদ্যোগ নিল কীভাবে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যায়। মনে রাখতে হবে, সে সময়ের আরেকটি জনস্বাস্থ্য প্রচারণা বাংলাদেশে সবে হোঁচট খেয়েছে। পরিবার পরিকল্পনার বার্তা এ দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডলের সঙ্গে তখন খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। খাওয়ার স্যালাইনের বেলায় যেন ও রকম পরিণতি না হয়, তা প্রথম থেকে খেয়াল রাখলেন ব্র্যাকের কর্তারা।
সে সময় বাংলাদেশের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষের কাছে রেডিও ছিল। টেলিভিশনের তো প্রশ্নই আসে না। আর খবরের কাগজ বা পোস্টারের লেখা পড়ার মতো অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ গ্রামেগঞ্জে কতজন ছিল, তা হাতে গুনে বলে দেওয়া যেত।
তাই ব্র্যাক গণমাধ্যমকে প্রায় ব্যবহারই করেনি। অথচ পশ্চিমা জনস্বাস্থ্যবিদদের প্রেসক্রিপশন ছিল, গণমাধ্যম বাদ দিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রচারণার অন্য সব পদ্ধতি সেকেলে এবং মশা মারতে কামান দাগানোর মতো অকার্যকর! ঘরে ঘরে গিয়ে জনে জনে খাওয়ার স্যালাইনের বার্তা প্রচার করার সেই ‘অকার্যকর’ পদ্ধতি বেছে নিল ব্র্যাক।
মহলানবীশের সহকারীরা বড় বড় ড্রামে ‘ঢাকা সলিউশন’ তথা খাওয়ার স্যালাইন বানাতে শুরু করেন। লাইন ধরে কলেরায় আক্রান্ত শরণার্থীদের তা খাওয়ানো হতে থাকে। অবশ্য যাঁদের ক্ষেত্রে তীব্র পানিশূন্যতা ছিল, তাঁদের বেলায় যত দূর সম্ভব শিরাপথে স্যালাইন দেওয়ার চেষ্টা ছিল।
পাইলট প্রকল্পে ৬০০টি গ্রামের ৬০ হাজার নারীর কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামল ব্র্যাকের স্বেচ্ছাসেবী দলগুলো। প্রতিটি দলে ছিলেন ১৪ জন করে কম বয়সী নারী, ১ জন বাবুর্চি আর ১ জন বয়স্ক পুরুষ দলনেতা। দলের কাঠামো এ রকম রাখার পেছনে সামাজিক বাস্তবতাই ছিল প্রধান কারণ। গ্রামের নারীরা তো নারীদের কথাই শুনবেন। বয়স কম হলে বেশি পরিশ্রম করতে পারবেন। নারীরা নিজেই নিজের খেয়াল রাখতে পারেন না—এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু নারীদের নিরাপত্তা বিধান করার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজ এখনো পুরুষকে দেখতে অভ্যস্ত। এর ব্যত্যয় ঘটালে যদি পুরো প্রকল্প মাঠে মারা যায়! সমাজকে বুঝে সমাজের উপযুক্ত উপায়ে বার্তা দেওয়াই আসল, যাতে সবাই তা গ্রহণ করে।
দেখা গেল, গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে খাওয়ার স্যালাইন প্রস্তুত করার বার্তা পৌঁছানোর কাজটা অত সহজ নয়। লিটারে পানি মাপার জন্য সেখানে নেই কোনো দাগাঙ্কিত পাত্র। চিনি ও লবণের মাত্রা ঠিক রাখার জন্য নেই কোনো বৈজ্ঞানিক মাপনি। লবণ সব ঘরে মিললেও চিনি তখনো বিলাসিতা। শেষতক আধা সের (প্রায় এক লিটার) পানিতে এক মুঠ গুড় এবং তিন আঙুলের এক চিমটি লবণ—এই হিসাবে স্যালাইনের রেসিপি ঠিক করা হলো। একেই বলে লাগসই প্রযুক্তি বা অ্যাপ্রোপ্রিয়েট টেকনোলজি। যার যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বলতে যা বোঝায়। প্রতিদিন কোনো গ্রামে ব্র্যাকের স্বেচ্ছাসেবকদের একেকটি দল তাঁবু ফেলে বেরিয়ে পড়ত প্রতিটি ঘরে গিয়ে মা-বোনদের এই রেসিপি শেখানোর জন্য। নিজে হাতে তৈরি করলে সবচেয়ে ভালো মনে থাকে, তাই স্বেচ্ছাসেবকেরা উৎসাহিত করতেন, যাতে মা-বোনেরা নিজ হাতে এটা তৈরি করে দেখান। বন্যা পরিস্থিতিতে পরিষ্কার নিরাপদ পানি পাওয়া একটা সমস্যা ছিল। ফুটিয়ে ঠান্ডা করে নেওয়ার মতো সুবিধা সব সময় ছিল না। অপরিষ্কার পানিতে তৈরি করা স্যালাইন, তা–ও মন্দের ভালো, কোনো ধরনের স্যালাইন না খাওয়ানোর তুলনায়। এতেও জীবন বাঁচে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিজেদের আস্তানায় ফিরে স্বেচ্ছাসেবী মাঠকর্মীরা রাতের খাবার সেরে নিতেন এবং সারা দিনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন। এতে চকিতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার সুযোগ থাকত, যাতে আগের দিনের পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের দিন আরও ভালোভাবে প্রাণ রক্ষাকারী বার্তা জনমানসে পৌঁছে দেওয়া যায়।
স্বেচ্ছাসেবীদের পারিতোষিক দেওয়ার ক্ষেত্রে কতজনকে তাঁরা প্রশিক্ষিত করতে পেরেছেন, তার চেয়ে বরং কত ভালোভাবে তাঁদের থেকে প্রশিক্ষিত হওয়া নারীরা পুরো প্রক্রিয়া মনে রাখতে পেরেছেন, এটা গুরুত্ব পেত, যাতে মাঠপর্যায়ে প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন নারী (পরবর্তী সময়ে পুরুষদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়) থাকেন, যিনি খাওয়ার স্যালাইন তৈরি ও খাওয়ানোর নিয়ম জানেন, তা নিশ্চিত করা যায়। একটা পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের প্রশিক্ষিত ব্যক্তিরা আশপাশে যাঁরা তখনো ওই নিয়ম শেখেননি, তাঁদের নিজ উদ্যোগে তা শেখাতে শুরু করলেন। তখন থেকে অভাবনীয় দ্রুতগতিতে এ বার্তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। চেইন রি–অ্যাকশনের মতো।
স্যালাইন দ্রবণে লবণের মাত্রা ঠিক রাখার জন্য উল্লিখিত রেসিপি যে কার্যকর, তা মাঠপর্যায়ে গ্রামীণ নারীদের প্রস্তুতকৃত নমুনা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেল। গবেষণাগারে চুলচেরা মানদণ্ডে হাজারে চারটি নমুনায় বিপজ্জনক মাত্রায় লবণ মেলে। আরও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেটাও সমাধান করা গেল। অর্থাৎ আমজনতার পক্ষে সঠিক মাত্রায় এই খাওয়ার স্যালাইন তৈরি করা এবং তা প্রয়োগ করে পানিশূন্যতাজনিত মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব, তা ব্র্যাকের পাইলট প্রকল্প দেখিয়ে দিল।
তারপর সরকারের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী এ প্রকল্প ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো। গণমাধ্যমে প্রচারণার ব্যাপারটি আরও অনেক পরে যুক্ত হয়। বিটিভিতে ‘ঘুটা ঘুটা’ বিজ্ঞাপন যখন থেকে প্রচার করা শুরু হয়, তার বহু আগেই বাংলার অনেক জায়গায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী খাওয়ার স্যালাইনের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকে সরকারি ওষুধ কারখানা, সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিসহ বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত পাউডার হিসেবে খাওয়ার স্যালাইন বিনা মূল্যে বিতরণ, স্বল্প মূল্যে বিক্রি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এর সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে কাজ শুরু করে। এর ফলে ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতা এবং এ কারণে মৃত্যু কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। এই জীবনদায়ী দ্রবণের সাফল্যের মূল সূত্র ছিল দুটি। প্রথমত, এটা এতটাই সরল এক দ্রবণ যে সরলতাই ছিল এর অন্যতম শক্তি। ঘরোয়া জিনিস দিয়ে সহজেই তৈরি করা যায়। কোনো ল্যাবরেটরি প্রশিক্ষণ লাগে না। শিরাপথে স্যালাইন দেওয়ার মতো যন্ত্রপাতি বা দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। দ্বিতীয়ত, সফলভাবে তথ্যটি জনমানসে গেঁথে দেওয়া। প্রথম সূত্রের থেকে এটি কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইতিহাসে বহু অসাধারণ আবিষ্কার মানুষের কোনো কাজে লাগেনি স্রেফ তা সঠিকভাবে প্রচার করা যায়নি বলে। তাই ব্র্যাকের ওই প্রচারণার কৌশল নিজেই এক পৃথক ইনোভেশন হিসেবে কৃতিত্বের দাবিদার।
বিশ্বজুড়ে এখনো প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতায় মারা যায়, যার মধ্যে প্রায় ৫ লাখ শিশু। যদিও তীব্র পানিশূন্যতার ক্ষেত্রে শিরাপথে স্যালাইন প্রয়োগ করার প্রয়োজন এখনো ফুরিয়ে যায়নি, তবু খাওয়ার স্যালাইন পানিশূন্যতাজনিত বেশির ভাগ মৃত্যু প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর, তা অনেক গবেষণায় প্রমাণিত। খাওয়ার স্যালাইনের সহজলভ্যতা বাংলাদেশে সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকলেও বৈশ্বিকভাবে অর্ধেকেরও বেশিসংখ্যক মানুষ এই সুবিধা থেকে আজও বঞ্চিত। বিশেষ করে আফ্রিকার স্বল্পোন্নত অঞ্চলগুলোয়। বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
সৌমিত্র চক্রবর্তী: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা