রংপুরের পালিচড়া গ্রামে মিলন মিয়ার বাড়ি। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতেন। পালিচড়া এম এন উচ্চবিদ্যালয় ও মজিদা খাতুন কলেজ মাঠে অনুশীলন করতেন।
অনুশীলন করতে করতে ভাবতেন, গ্রামের মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলবেন। ভেবেই বসে থাকলেন না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝালেন। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই হতদরিদ্র। কৃষিজীবী। দিনমজুরও আছে। অন্যের জমি বর্গা নিয়েও সংসার চালান কেউ কেউ।
এসব ঘরের মেয়েদের মাঠে নিয়ে এসে প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন। কিন্তু হতদরিদ্র এসব পরিবারের মেয়েদের দুবেলা ঠিকমতো খাবারও জোটে না। আবার মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটলেন মিলন। সাড়াও পেলেন। ‘প্রথম আলোও আমাদের পাশে দাঁড়ায়। ২০১৬ সালে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়। সেই টাকা দিয়ে মেয়েদের জার্সি কেনা হয়। নির্মাণ করা হয় ক্লাবঘর।’ পুরোনো দিনে ফিরে গেলেন মিলন মিয়া।
রংপুর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের অজপাড়াগাঁ পালিচড়া এখন নারী ফুটবলের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই গ্রামের মেয়েরা এখন ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে খেলছে। বিদেশের মাটিতে খেলে শিরোপাও জয় করেছে। তাদেরই সাফল্যে পালিচড়ায় নির্মিত হয়েছে একটি মিনি স্টেডিয়াম।
পালিচড়া এম এন উচ্চবিদ্যালয় ও মজিদা খাতুন কলেজের মাঠে গত মাসেই নির্মিত হয়েছে এই স্টেডিয়াম। সেই মাঠেই প্রতিদিন বিকেলে চলে নারী ফুটবলারদের অনুশীলন। এদের অধিকাংশেরই বয়স ৮ থেকে ১৪ বছর। একদিন সরেজমিনে দেখা গেল, অনুশীলন শুরুর আগে কেউ পায়ে বুট পরছে, কেউ গায়ে জার্সি জড়িয়ে নিচ্ছে।
অনুশীলনের জন্য মাঠে মার্কার বসানো হয়েছে। এই মার্কারের ফাঁকফোকর দিয়ে অনুশীলন চলছে। চলছে বল আদান-প্রদান। আবার কখনো চলছে ফুটবল হাতে–পায়ে নিয়ে শারীরিক কসরত, মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বল নিয়ে ছুটে চলা।
এই গ্রামের প্রায় ৩০ জন মেয়ে বর্তমানে নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তাদের স্বপ্ন ঢাকার ক্লাবে খেলা। জাতীয় পর্যায়ের ফুটবলে অংশ নেওয়া। অভিভাবকেরাও তাঁদের কাজের ফাঁকে সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে উৎসাহ প্রদান করে চলেছেন। সেই সঙ্গে গ্রামের লোকজনেরাও তাদের উৎসাহিত করছেন।
এই পালিচড়ার মাঠ থেকেই উঠে এসেছেন সিরাত জাহান, ইসরাত জাহান, মৌসুমী আক্তার, রুনা আক্তার, রুমি আক্তার, জয়নব বিবি, সুলতানা আক্তার, নুশরাত জাহান, লাবনী আক্তার, রেখা আক্তার। এই ১০ খেলোয়াড়সহ ২০-২১ জন ঢাকায় বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে নিয়মিত নারী ফুটবল লিগে খেলছেন। তাঁদের মধ্যে ১০ নম্বর জার্সি পরে সিরাত জাহান এবার সাফ গেমসে শিরোপাজয়ী দলে খেলেছেন।
এই নারী খেলোয়াড়দের মধ্যে আছেন একই পরিবারের তিন বোন—রুনা আক্তার, রুমি আক্তার ও জয়নব বিবি। তাঁদের বাবা রবিউল ইসলাম। স্টেডিয়ামের পাশের বাজারে তাঁর ছোট্ট চায়ের স্টল। এই বাজারেই নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে ‘সদ্যপুষ্করিণী যুব স্পোর্টিং ক্লাব’। এই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হলেন গর্বিত এই তিন বোনের মা লাভলী বেগম।
লাভলী বেগম বলেন, ‘তিনটা মেয়েই দেশের বাইরে ইন্দোনেশিয়া, ভুটান, হংকং, ভারতে খেলেছে। আমাদের মেয়েদের জন্য এই গ্রামের নাম এখন সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে।’
২০১৬ সালে দেশের বাইরে তাজিকিস্তানে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্বে ভারতকে ৯-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। এই বিজয়ী দলে ছিলেন এ গ্রামেরই তিন ফুটবলার—লাবনী আক্তার, আর্শিতা জাহান ও আঁখি আক্তার। এর আগে দেশের বাইরে নেপালে খেলেছেন সিরাত জাহান। মৌসুমী আক্তার খেলতে গিয়েছিলেন পাকিস্তান।
মিনি স্টেডিয়ামে অনুশীলন করার ফাঁকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী রত্না আক্তার বলেন, ‘আপুদের মতো আমরাও ফুটবল খেলব ঢাকার ক্লাবে। তাদের মতো আমিও স্বপ্ন দেখি, ভালো ফুটবলার হব।’
অষ্টম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী সুলতানা আক্তার বলেন, ‘মা-বাবার ইচ্ছায় ফুটবল খেলতে নেমেছি। আমিও আপুদের মতো একদিন বিদেশে খেলব। ছিনিয়ে আনব জয়।’
কৃতী নারী ফুটবলার রেখা আক্তারের বাবা কৃষক বুলবুল আহমেদ বললেন, ‘গ্রামের মেয়েদের খেলা নিয়ে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। একদিন এই গ্রামের আরও অনেক মেয়ে বড় ফুটবলার হবে, এটা আমার বিশ্বাস।’
১৫ নভেম্বর ঢাকায় শুরু হচ্ছে নারী ফুটবল লিগ। সেই লিগে উত্তরাঞ্চলের একমাত্র দল ‘সদ্যপুষ্করিণী যুব স্পোর্টিং ক্লাব’।
লেখক: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর