জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
জামিলুর রেজা চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, বাংলাদেশের রূপকারদের একজন। কম্পিউটার, আইটি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ আন্দোলন, ডিএপি, সড়ক সমন্বয়, ইমারত বিধিমালা, পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু—জাতীয় পর্যায়ে এসব ক্ষেত্রে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, সেসবের পেছনে তাঁর নেতৃত্ব কাজ করেছে।
তিনি ছিলেন মানবিক প্রকৌশলী। যিনি জানতেন শিল্প, সাহিত্য, নাটক, সংগীত, চিত্রকলা, ফিল্ম এবং মানুষ নিয়েই একজন প্রকৌশলী। আর ছিলেন অস্বাভাবিক মেধাবী একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। বিদেশে এফ আর খানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েও দেশে ফিরে এসেছিলেন।
বুয়েটে স্যার আমাদের পড়াতেন স্ট্রাকচার, ট্রাস। স্যার এমনভাবে পড়াতেন, যেন তিনি একটা মানবিক কম্পিউটার। প্রথম দশ মিনিটে বলতেন, ‘গত ক্লাসে আমরা শিখেছি’; পরের কুড়ি মিনিটে নতুন পড়া পড়াতেন। শেষ দশ মিনিটে যা পড়িয়েছেন, তা আবার বলতেন এবং ছাত্রদের প্রশ্ন করার সুযোগ দিতেন। ফলে ক্লাসেই স্যারের শেখানো পড়া আমরা শিখে ফেলতে পারতাম। পরীক্ষায় তিনি যা পড়িয়েছেন, তা-ই প্রশ্নে দিতেন।
স্যারের বুদ্ধিমত্তা ছিল কম্পিউটারের
মতো। কিন্তু তার চেয়ে বড় ছিল হৃদয়। স্যারের কোন ছাত্র পৃথিবীর কোনখানে আছে, তা ছিল তাঁর মুখস্থ। পাস করে বেরিয়ে আসার
পরেও স্যার আমার খোঁজ নিতেন, ‘তুমি কী করছ?’
‘পত্রিকায় কাজ করছি।’
‘ভেরি গুড। করো। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা সব করতে পারে। দেখো, আবুল হায়াত কত সুন্দর অভিনয় করছেন।’
স্যার প্রচুর বই পড়তেন, প্রচুর সিনেমা দেখতেন, প্রচুর গান শুনতেন এবং প্রচুর মানুষের সঙ্গে মিশতেন। এ বিষয়ে তিনি এফ আর খানের দর্শন মানতেন। প্রকৌশলবিদকে মানবিক হতে হবে। মানুষের কাছে যেতে হবে। এফ আর খান বলেছিলেন, ‘একজন প্রযুক্তিবিদের আপন টেকনোলজিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হবে, আর জীবন হলো শিল্প, সংগীত, নাটক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জীবন হলো মানুষ।’
স্যারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম প্রথম আলোয়, তাঁর মৃত্যুর ১০ দিন আগে। করোনাকালে সরকারের কী করণীয়, নাগরিকদের কী করণীয়। স্যার বলেছিলেন, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিম্নবিত্ত মানুষদের টাকা পাঠাতে হবে। সেটা স্যারের লেখা হিসেবে পরের দিন প্রথম আলোয় ছাপা হলো। তিনি আমাকে এসএমএস পাঠালেন, ‘আনিস, আমি কী এমন বললাম, তুমি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে লিখেছ। ধন্যবাদ।’
সেটাই ছিল আমার সঙ্গে স্যারের শেষ কথা।
স্যার একটা আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। যেমন ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড। পরিবেশ আন্দোলন। তিনি বঙ্গবন্ধু সেতু, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশেষজ্ঞ-পরামর্শক ছিলেন।
আজকে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ আমরা দেখছি, তার শুরুর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্যার। দেশের প্রথম কম্পিউটার-প্রবর্তকদের তিনি একজন। ছিলেন বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের প্রধান, যদিও তিনি নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৬৮ সালে স্যার যখন দেশে আসেন, সারা ঢাকায় তখন তিন-চারটি মোটে কম্পিউটার। অ্যাটমিক এনার্জি, ঢাকা সেন্টার আর কিছু বেসরকারি ব্যাংকে এসব কম্পিউটার পরিচালিত হতো। বুয়েটের সিলেবাসেও তখন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ছিল না। প্রফেসর আবদুল মতিন পাটোয়ারীকে নিয়ে কম্পিউটারভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়ন করলেন স্যার। ছাত্রদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখানো এবং এর মাধ্যমে প্রকৌশল সমস্যা সমাধানের প্রথম দায়িত্ব পেলেন স্যার। অ্যাটমিক এনার্জি সেন্টারের একটি মাত্র কম্পিউটার দিয়ে এত এত ছাত্রকে শেখানো—কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। অনেক প্রচেষ্টার পর ১৯৭৯ সালে প্রায় এক কোটি টাকা খরচ করে সেই সময়ের সবচেয়ে আধুনিক কম্পিউটার, তৃতীয় প্রজন্মের মেইন ফ্রেম আইবিএম ৩৭০-১১৫, কিনে আনা হয়। প্রায় এক দশক সেটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন স্যার।
বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষক তো বটেই, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরাও বিনা মূল্যে তখন বুয়েটের এই কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারত। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক শিক্ষার্থী থিসিস কিংবা গবেষণার কাজে আসত। তাদেরও বিনা মূল্যে কম্পিউটারসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন স্যার। তবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে সেবা নিতে হলে দিতে হতো পরিমিত অর্থ। এই অর্থ দিয়েই প্রায় ছয়-সাত বছর পরে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে আরেকটি কম্পিউটার, আইবিএম ৪৩৩১, কেনে
বুয়েট। এভাবেই এই অঞ্চলে শুরু হয় কম্পিউটারচর্চা, আস্তে আস্তে যা সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে।
আরও কত কিছু যে করতেন স্যার। এই যেমন প্রথম আলোর সঙ্গে করতেন গণিত অলিম্পিয়াড। ছিলেন গণিত অলিম্পিয়াডের সভাপতি। ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ১৯৯৬-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। স্যার খেলাধুলা পছন্দ করতেন। ভালো ক্রিকেট খেলতেন। ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। ফিল্ম ক্লাব করতেন। সুডোকু তাঁর পছন্দ ছিল। প্রায়ই প্রথম আলোয় ফোন করে সুডোকুর ভুল ধরিয়ে দিতেন।
২০০৪ সালে গণিত উত্সবের সমাপনী পর্বে তিনটি স্বপ্নের কথা বলেছিলেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। প্রথম স্বপ্ন, ২০১০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের পদক। যে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয় স্বপ্ন, ২০২২ সালের ভেতর কোনো বাংলাদেশির গণিতের নোবেল ‘ফিল্ডস মেডেল’ জয়। তৃতীয় স্বপ্ন, ২০৩০ সালের ভেতরে কোনো বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর নোবেল পদক। তাঁর শেষ দুটি স্বপ্ন এখনো অধরা, পূরণ করতে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে আগামী প্রজন্ম।
আনিসুল হক: জামিলুর রেজা চৌধুরীর
ছাত্র; কথাসাহিত্যিক; ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, প্রথম আলো