সারোয়ার তুষার
সারোয়ার তুষার

গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সম্ভব নয়

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার বাস্তবতায় এর তাৎপর্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা, সংলাপ ও বাহাস চলছে। আইন ও দর্শনশাস্ত্র অনুযায়ী গণ–অভ্যুত্থান এক গাঠনিক মুহূর্ত, যা পুরোনো ও নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ছেদবিন্দু হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ গণ–অভ্যুত্থানের পর নতুন ব্যবস্থার গোড়াপত্তনের সম্ভাবনা যেমন প্রবল থাকে, আবার পুরোনো ব্যবস্থার দিকে তথা পেছন দিকে টেনে নেওয়ার দুরভিসন্ধিও বিরাজ করে। শেষতক কোনটা বিজয়ী হবে, তা নির্ভর করে কোন ধরনের শক্তি সমাবেশ কেমন রাজনীতি নিয়ে রাজপথে সক্রিয় থাকতে পারছে, তার ওপর।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞায় রাজনৈতিক দলের প্রসঙ্গ উল্লেখ থাকে না। কিন্তু রাজনৈতিক দল যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলের প্রসঙ্গ আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এ দেশের শান্তি, (অ)স্থিতিশীলতা বা উন্নতি ও অনুন্নতির পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই প্রধান।

তবে যে শ্রেণির হাতে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব, তাদের শ্রেণিস্বার্থের ঊর্ধ্বে রাজনৈতিক দলগুলো উঠতে পেরেছে, তা বলা যাবে না। এ কারণে প্রায়ই বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা সেই সত্য আবার সামনে এনেছে।

দেয়াললিখনে দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনের আহ্বান। রাজধানীর পলাশীতে

গত জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। সেই আন্দোলনে জনগণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেনি। আন্দোলন সফলও হয়নি। জনগণ নির্বাচন ও ভোটবিমুখ, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন উৎসবে রূপ নেয়। তবে এ কথাও ঠিক যে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচন ক্ষমতার হাতবদল ছাড়া আর কিছু নয়, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার কারণে জনগণের কাছে এটাও এক মীমাংসিত সত্য। ফলে আমরা দেখলাম, একদিকে জানুয়ারি মাসে নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে জনগণ সাড়া দেয়নি, অন্যদিকে ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে জনগণ ডামি নির্বাচনকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। এ থেকে স্পষ্ট যে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ন রেখে নির্বাচনের দাবিকে জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর স্রেফ ক্ষমতায় যাওয়ার দাবি হিসেবে বিবেচনা করে। এ দাবি রাজনৈতিক দলগুলোকেই আদায় করে নিতে হবে বলে জনগণ মনে করে। আদায় করতে পারলে, তথা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন হলে জনগণ ভোটে অংশগ্রহণ করবে ঠিকই, কিন্তু এ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলবে না।

তার মানে দলীয় রাজনীতি এবং গণরাজনৈতিক ধারার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। কোনো রাজনৈতিক দল সাংগঠনিকভাবে বৃহৎ হলেই যে ‘গণরাজনৈতিক’ দল, ব্যাপারটা অত সরল নয়। কোনো দল গণরাজনৈতিক ধারার দল কি না; সংশ্লিষ্ট দলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি তা ঠিক করে দেবে। এ কারণেই অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক দাবি করেছিলেন, ভারতবর্ষে কোনো রাজনৈতিক দল ‘নাই’।

বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতায় যেতে পারাটাই মুখ্য। রাষ্ট্রকাঠামোর অগণতান্ত্রিকতা দলগুলোর বিবেচনার বিষয় নয়। আলংকারিকভাবে ‘গণতন্ত্র’ বর্গটির এস্তেমাল করলেও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতন্ত্রায়ণের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল—বিশেষত বড় দুটি দল—কখনোই বড় ধরনের কোনো চেষ্টা করেনি। এখানে খেয়াল রাখা আবশ্যক যে নির্বাচন তথা ভোটাভুটি নিজ গুণে গণতান্ত্রিক কিংবা অগণতান্ত্রিক হয় না। রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হয়, সে ক্ষেত্রে নির্বাচন গণতান্ত্রিক কায়দায় সরকার বেছে নেওয়ার তথা গণতন্ত্রচর্চার রূপমাত্র। অন্যদিকে রাষ্ট্র যদি অগণতান্ত্রিক হয়, সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ ছাড়া আর কিছু অর্জন সম্ভব নয়।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে সংস্কার ও পুনর্গঠনের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছে। সংবিধান পরিবর্তনের দাবি উঠে এসেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কার কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে সংস্কার প্রয়োজন, এ ধরনের আলাপ শুরু হয়নি।

অথচ বাংলাদেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সাংগঠনিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনা জরুরি। ইতিমধ্যে আমরা বলেছি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বানানোর আকাঙ্ক্ষা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে জরুরি বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ছাড়া রাষ্ট্র পুনর্গঠন সম্ভব কি না। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক কাঠামোর গণতন্ত্রায়ণের কোনো বিকল্প নেই। পরিবারতন্ত্র, পদ ও মনোনয়ন–বাণিজ্য, চাঁদাবাজি-লুটপাটের মতো গণবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে দলগুলোকে বেরিয়ে আসতে হবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কর্মী-সংগঠকদের মতামতের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত হলে সেই নেতা নিজেকে দলের অধীন মনে করবেন। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মপরিকল্পনা দেশবাসীকে জানাতে হবে। দলীয় ক্ষমতা গণক্ষমতার অধীন—এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অপরিণামদর্শিতার ঐতিহাসিক পটভূমি আমলে নেওয়া দরকার। আমাদের দেশে যেসব রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে বা নতুনভাবে গড়ে উঠছে, তারা প্রায় সবাই হয় কংগ্রেস অথবা মুসলিম লীগের মডেল অনুসরণ করেছে। এই দুই ধারার বাইরে শ্রমিক-কৃষকসহ খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তির জন্য বামপন্থী ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে উঠেছে বামপন্থী দলগুলো। এ ছাড়া আছে ইসলামিক রাজনীতি।

এ দলগুলো মোটাদাগে বিদেশি কোনো না কোনো রাষ্ট্র, দল বা ভাবাদর্শের অনুকরণ বা পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট ও পরিচালিত। এসব দল বা সংগঠনের গঠনের ইতিহাস বা কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া কতিপয় মানুষ সম্মিলিত হয়ে প্রথমে একটি দল গঠন করে কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং এরপর জনমানুষকে তাদের দলে যোগদান ও তাদের কর্মসূচি সমর্থনের জন্য আহ্বান জানায়। এভাবে গঠিত দলগুলো প্রথম থেকেই নেতা আর কর্মীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। নেতাদের পদ হয়ে যায় স্থায়ী, যা আবার পারিবারিক উত্তরাধিকারদের কাছে হস্তান্তর হয়। দলীয় কর্মীদের মালিকানা তো দূরের কথা, নেতৃত্বের বিকাশই প্রতিষ্ঠিত হয় না। কর্মীদের কাছে নেতাদের জবাবদিহির বদলে কর্মীরাই নেতাদের আজ্ঞাবহ থাকতে বাধ্য থাকে। এ ধরনের দল তাদের কাগজপত্রে যা-ই লিখুক বা মুখে যা-ই বলুক না কেন, যে দলের অভ্যন্তরে কর্মী-সমর্থকদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, সে দলের দ্বারা কখনোই জনগণকে রাষ্ট্রক্ষমতার মালিক তথা গণরাষ্ট্র বানানো সম্ভব নয়। এমনকি তাদের পক্ষে গণমানুষকে রাষ্ট্রের মালিক বানানোর প্রকৃত রাজনীতিও করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, নামে রাজনৈতিক দল হলেও একধরনের ক্লাব–সংস্কৃতির প্রাধান্যই লক্ষ করা যায়।

বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজ এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। গণতন্ত্র স্রেফ ভোটাভুটি নয়। জনগণের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই রীতিনীতি নিয়ে কোনো তর্ক করা চলে না। কিন্তু খোদ রাষ্ট্রকাঠামোই যদি অগণতান্ত্রিক হয়, তাহলে নির্বাচন জনগণের কষ্টে উপার্জিত অর্থের শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কিছুই হয় না। বাংলাদেশের সাংবিধানিক ক্ষমতাকাঠামোর ধরনটাই এমন যে জনগণের ভোট দেওয়া না–দেওয়ায় কিছু যায় আসে না। তবু ‘মন্দের ভালো’ পঞ্চবার্ষিক ভোটাভুটিটুকুও যে গত এক দশকে উঠে গেল, এর বীজ বাংলাদেশের সংবিধানেই ঘাপটি মেরে ছিল। সেই অগণতান্ত্রিক মহাদানব গত তিনটি তামাশার নির্বাচনে মাথাচাড়া দিয়ে দৃশ্যমান হওয়ায় আমাদের মাথা খারাপ দশা হয়েছিল। বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের পথপরিক্রমায় কখনোই কোনো দলকে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়তে দেখা যায়নি (২০০১ সাল একমাত্র ব্যতিক্রম; ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে নির্বাচন আয়োজনে বাধা সৃষ্টি করেনি)। ফলে ক্যু, পাল্টা ক্যু, সামরিক শাসন এবং সেই শাসনের বিরুদ্ধে নাগরিক অভ্যুত্থান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন, আবার বাতিল করে দিয়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা, লগি-বইঠা, এক–এগারোর সুশীলবেশী সামরিক সরকার—নানা অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। এ পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেই মুখ্য দায় নিতে হবে।

ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ পথ বের করার মতো আধুনিক রাষ্ট্রের প্রাথমিকতম সমঝোতাটুকুও দলগুলো সম্পন্ন করতে পারেনি। এর কারণ দলগুলোর অভ্যন্তরীণ অগণতান্ত্রিকতা, রাষ্ট্রনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়ার প্রতি দলগুলোর অনীহা, অগণতান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো এবং দলীয় পরিবারতন্ত্র। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন করা জরুরি। আসনভিত্তিক সংসদ সদস্য নয়; সংসদে আসন বণ্টন হবে প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হিসাবে। কোনো দল ৪০ শতাংশ ভোট পেলে সংসদে ১২০টি আসন পাবে (১ শতাংশ ভোটের বিপরীতে তিনটি সংসদীয় আসন)। দলের কোন ১২০ জন সংসদে যাবেন, তা সংশ্লিষ্ট দলই ঠিক করবে। নির্বাচনের আগে থেকেই দলগুলো ৩০০ প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে। তালিকা ক্রম অনুযায়ী ১২০ জন সদস্য সংসদে যাবেন। এতে করে কোন ১২০ জন সদস্যের নাম তালিকার ওপরের দিকে থাকবে, তা নির্ধারণের জন্য দলের ভেতর গণতন্ত্রচর্চার পরিসর বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে। এ ক্ষেত্রে মনোনয়ন–বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য দলীয় গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার থাকা যেমন প্রয়োজন, তেমনি গঠনতন্ত্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারও অনিবার্য।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই সার্বভৌম। বাংলাদেশের বিদ্যমান গণবিরোধী সংবিধানে প্রস্তাবে পর্যন্ত গণসার্বভৌমত্বের ধারণাকে অস্বীকার করা যায়নি। রাজনৈতিক দল জনগণের মনিব নয়, জনগণের অধীন—এই সত্য মানা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী কোনো গণতান্ত্রিক দল গঠন সম্ভব নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের পর গণপরিসরে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিগঠনের সচেতনতা ও বাসনা তীব্র হয়েছে। অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকাঠামো বহাল রেখে সংসদ নির্বাচনের দাবি না তুলে, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপযোগী করে নিজেদের তৈরি করা তথা রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতি গ্রহণ করা। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোকে অপরিবর্তিত রেখে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম সম্ভব নয়।

* সারোয়ার তুষার: লেখক; জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য