দুই দশক ধরে খবর বিলিয়ে যাচ্ছেন মরিয়ম বেগম

দিনাজপুর শহরের একমাত্র নারী হকার মরিয়ম বেগম
 ছবি: প্রথম আলো

দিনাজপুর শহরের মডার্ন মোড়, গণেশতলা, নিমতলা, বাহাদুর বাজার, হাসপাতাল মোড়সহ শহরজুড়ে মরিয়ম বেগম একটি পরিচিত মুখ। বিশেষ করে কাছারি এলাকার (আদালত চত্বর)  প্রায় সবাই চেনেন। তাঁর কোলে থাকে খবরের কাগজ। হেঁটে এসব এলাকায় খবরের কাগজ বিক্রি করেন। পরিচিত-অপরিচিতজনের জটলা কিংবা এক নিবিষ্টে বসে আছেন, এমন কাউকে দেখলেই কাছে যান মরিয়ম। মৃদু হাসি নিয়ে বলেন, ‘গরম খবর আছে নেন, বাড়িওলি সুইদ্ধা পড়বেন।’ অবশ্য এখন অন্যরাই উল্টো মরিয়মকে বলেন, ‘আপা, আজকের গরম খবর কী?’

দিনাজপুর শহরের একমাত্র নারী হকার মরিয়ম বেগম (৪৪)। শহরের হঠাৎপাড়া এলাকায় খাসজমিতে থাকেন। ২০ বছর ধরে খবরের কাগজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মরিয়মের বাবার বাড়ি সিলেট। মায়ের বাড়ি ফরিদপুর। কাজের সন্ধানে মা গিয়েছিলেন সিলেটে। সেখানেই বিয়ে হয় মরিয়মের মা-বাবার। মরিয়ম যখন গর্ভে, তখন পরিচিত একজনের সহযোগিতায় মা চলে আসেন দিনাজপুর উপশহর এলাকায়। গৃহকর্মীর কাজ নেন। এরপর মরিয়মের জন্ম হয়। বাসাবাড়ির কাজ ছেড়ে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করে মেয়েকে বড় করেন মা। পরে হঠাৎপাড়া এলাকায় ঘর তুলে বসবাস শুরু করেন।

পড়ালেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি মরিয়মের। নিজে পড়ালেখার সুযোগ না পেলেও অন্যকে পড়ানোর কাজটি করেন যত্নসহকারে। ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করেন তিনি ‘৭ বছর বয়সে বকুল ফুলের মালা তৈরি করে স্কুল–কলেজের সামনে বিক্রি করেছেন। বোতল, প্লাস্টিক, ভাঙারি, লোহাসহ বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করে বিক্রি করে মায়ের হাতে টাকা তুলে দিতেন। তারপর সময় গড়িয়েছে। একটা সময় মায়ের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ শুরু করেন।

মরিয়মের স্বামী ছিলেন রিকশাচালক। বিয়ের এক মাসের মাথায় আবারও কাজে নামতে হয়েছে। এরই মধ্যে তিন সন্তানের মা হয়েছেন। হঠাৎ একদিন স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে অন্যত্র চলে যান স্বামী। বাড়ির সামনে সবজির দোকান দেন। কিছুদিন পরে কাচারীতে শুরু করেন কলার ব্যবসা। সেখানেও ভাটা পড়ে। অন্ধকার দেখতে শুরু করেন। একদিন কাছারিতে স্থানীয় এক সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর হাত ধরে ২০০২ সালে খবরের কাগজ বিক্রির পেশায় নামেন। মরিয়ম জানান, শুরুতে এজেন্ট থেকে পত্রিকা বাকি দিতে চাইত না। বর্তমানে এজেন্টের কাছে খুবই বিশ্বস্ত তিনি।

ভোরের আলো ফুটলেই ঘুম ভাঙে মরিয়মের। এজেন্টের দোকানে আসেন সকাল নয়টায়। পত্রিকা বুঝে নিয়ে প্রথমে ছোটেন কাছারিতে। তাঁর অধিকাংশ গ্রাহক আইনজীবীসহ কাছারি এলাকায় অবস্থানরত মানুষ। নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দিয়ে হেঁটেই শহরে আসেন। কয়েকজনের কাছে পত্রিকা দিয়ে আবার ছোটেন কাছারিতে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। মরিয়ম বসে পড়েন কাছারির বটতলায়। মুখে পোরেন ছোলামুড়ি কিংবা পাউরুটি কলার সঙ্গে এক গ্লাস পানি। বেলা তিনটা নাগাদ আসেন এজেন্ট পয়েন্টে। মহাজনের টাকা পরিশোধ করে ছোটেন বাহাদুর বাজারে। বাজারসদাই শেষে যখন বাড়ি ফেরেন, তখন বিকেল পাঁচটা। এই রুটিন মরিয়মের নিত্যকার।

বর্তমানে দৈনিক ১০০ থেকে ১২০ কপি পত্রিকা বিক্রি করেন মরিয়ম। নগদ বিক্রির পাশাপাশি নির্দিষ্ট কয়েকজন গ্রাহকের কাছে বাকিতেও বিক্রি করেন। প্রতি বৃহস্পতিবার টাকা নেন। ওই দিন এজেন্টকেও সপ্তাহের হিসাব মিটিয়ে দেন। সপ্তাহে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লাভ থাকে তাঁর।

মরিয়ম জানান, করোনার আগে দৈনিক ২০০ কপি পত্রিকা বিক্রি করেছেন। সপ্তাহে আড়াই-তিন হাজার টাকা লাভ থাকত। করোনায় পত্রিকা বিক্রি কমে যাওয়ায় বেশ কষ্টে কেটেছে দিন। হকার সমিতি থেকে সে সময় ৩০ কেজি চাল পেয়েছিলেন। সম্প্রতি পেপার বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। তবে আগের মতো ডেকে ডেকে মানুষ পত্রিকা কেনে না।

মরিয়ম বলেন, ‘সারা জীবন পত্রিকা বিক্রির সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম, তবে এখন বলছি, পত্রিকা বিক্রি ১০০ কপির নিচে নামলে এই পেশায় থাকা মুশকিল হবে।’

মরিয়মের বড় ছেলে বিয়ে করে সংসার নিয়ে আলাদা থাকেন। ছোট ছেলে ঘড়ির দোকানে কাজ করেন। একমাত্র মেয়ে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মরিয়মের সঙ্গে থাকেন। নাতনিও থাকে তাঁর সঙ্গে। সামান্য আয় দিয়ে টানাটানি করে চলছে সংসার। সমিতি থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ঘর মেরামত করেছেন। তারপরও টিন ফুটো হওয়ায় এবারের বর্ষাটা কষ্টে কেটেছে। সাপ্তাহিক কিস্তি দিতে হয় ৬০০ টাকা। বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম। কোনোমতে দিন কাটছে তাঁদের।

কাচারিতে অনেক গ্রাহকই আগাম টাকা দিতে চান মরিয়মকে। মরিয়মের কথা, হঠাৎ যদি মৃত্যু হয়। টাকা শোধ হবে কীভাবে? এ জন্য কারও কাছে আগাম টাকা নিতে চান না। বিভিন্ন উৎসবে অনেকের কাছে শাড়ি-কাপড় উপহার পান। কাপড় কিনতে হয়, না তাঁকে। বলেন, ‘যত দিন শরীর চলবে, তত দিন পরিশ্রম করব। যা আয় করি, সংসার চলে না। পেশাটার প্রতি মায়া পড়ে গেছে।