বাংলার মুখ

সামন্ত লাল সেনের বড় চিকিৎসক হতে না পারার গল্প

অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন
ছবি: সুমন ইউসুফ

সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা করাতে সমাজের উচ্চবিত্তরা সাধারণত আগ্রহ দেখান না। ব্যতিক্রম শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, সংক্ষেপে বার্ন ইনস্টিটিউট। বস্তিবাসী, সাধারণ শ্রমিক, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে শুরু করে অভিনেতা, ব্যবসায়ী—আগুনে পোড়ার চিকিৎসা নিতে এই প্রতিষ্ঠানেরই দ্বারস্থ হন সবাই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কাছে গড়ে উঠেছে বিশাল এই প্রতিষ্ঠান। ৫০০ শয্যার এই ইনস্টিটিউট পোড়া রোগীর চিকিৎসায় শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। তবে প্রতিষ্ঠানটি ৫০০ শয্যা হওয়ার পেছনে আছে নিষ্ঠা, মনোযোগ ও ত্যাগের কাহিনি।  বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘বলতে পারেন শুরু হয়েছিল ৫ শয্যা দিয়ে। আজ তা ৫০০ শয্যা। মাঝে লম্বা সময়, নানা চড়াই–উতরাই।’

যে চিকিৎসক ইনজেকশন দিতে পারে, সে রকম চিকিৎসকই হতে হবে—ছোটবেলায় সামন্ত লাল সেনের এমনই ছিল মনোবাঞ্ছা। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় কখনো ভাবেননি একদিন আগুনে পোড়া রোগীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হবেন। প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু ডা. গার্স্টকে এনেছিলেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি শুরু হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে বানিয়াচং থেকে বদলি হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসি। স্বপ্ন নিয়ে প্লাস্টিক সার্জারিতে কাজ শুরু করি।’

১৯৮০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলি হয়ে আসেন সামন্ত লাল সেন। পোড়া রোগীদের তখন ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে রাখা হতো। এমনকি বারান্দায় বা বাথরুমের পাশেও রোগীদের ঠাঁই হতো। তখন সার্জারি বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক কবির উদ্দীন আহমেদ। আগুনে পোড়া রোগীদের জন্য পৃথক কিছু করার চিন্তা শুরু করেন তাঁরা। মাত্র পাঁচটি শয্যা দিয়ে ৩৪/বি নামে একটি ওয়ার্ড চালু করেন। 

ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পোড়া চিকিৎসার আয়োজন। ২০০০ সালে ঢাকা মেডিকেলে ৫০ শয্যার বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং ২০০৩ সালে সামন্ত লাল সেনের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে ওই ইউনিট। চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেন অধ্যাপক সেন।

২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ১১৭ জন, আহত হন প্রায় ৫০০ মানুষ। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে আগুনে পোড়া রোগীর ঢল নেমেছিল সেদিন। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা পায়। পাশাপাশি পোড়া রোগীদের চিকিৎসার সীমিত সুযোগ–সুবিধার বিষয়টিও সামনে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই জরুরি ও জটিল চিকিৎসার আয়োজন বাড়ানোর নির্দেশ দেন।

২০১২ সালে ইউনিটকে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয় এবং দেশের ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু করা হয় স্বতন্ত্র বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। সারা দেশে তিন শর বেশি পদ সৃষ্টি করা হয়। একপর্যায়ে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের শয্যাসংখ্যা বেড়ে হয় ৩০০।

সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘দুর্গন্ধের কারণে রোগীদের পাশে কেউ যেতে চায় না। পোড়া রোগীদের কী কষ্ট, তা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এসব রোগীর চিকিৎসার জটিলতা আমি জানি। তাই সব সময় চেয়েছি মানুষ সচেতন হোক, মানুষ আগুনে না পুড়ুক, মানুষ হাসপাতালে না আসুক।’

অগ্নিদগ্ধদের উন্নত চিকিৎসা, পোড়া রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’–এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি ১৮ তলা ভবনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে অতিদরিদ্র রোগীও চিকিৎসা পাচ্ছেন। সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘কিছু পোড়া রোগীর যন্ত্রণা লাঘবের জন্য শীতল পরিবেশ খুবই দরকার। সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বহু বছর ধরে ভেবেছি। আজ কিছুটা স্বস্তি বোধ করছি।’

পোড়া রোগীর চিকিৎসায় প্রশিক্ষিত জনবল আগের চেয়ে বেড়েছে। পোড়া রোগীর চিকিৎসায় বিশেষ নির্দেশিকা তৈরি হয়েছে, সেই নির্দেশিকা সারা দেশের চিকিৎসকদের মধ্যে বিতরণ করার পাশাপাশি চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ বিনিময়ের কাজ করছে বার্ন ইনস্টিটিউট।

দেশে পোড়া রোগীর চিকিৎসাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখায় রূপান্তর করার ক্ষেত্রে অধ্যাপক সেনের অবদান অনেক। তবে তিনি নিজে মনে করেন এটা দলগত প্রচেষ্টার ফল, ‘সবাই সাহায্য করেছে। আমি শুধু ত্যাগ স্বীকার করেছি। আমি হয়তো ধনাঢ্য বা বড় চিকিৎসক হয়ে উঠতে পারিনি, কিন্তু জরুরি চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক তৈরি করতে পেরেছি, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পেরেছি।’

লেখক: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি