আওয়ামী লীগের জন্ম কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে, ১৯৪৯ সালে। গোলাপবাগানে গোলাপ ফোটে, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও আওয়ামী লীগ গোলাপের মতো সুবাস ছড়িয়েছে বিভিন্ন সময়। তবে গোলাপে থাকে কাঁটাও। আওয়ামী লীগের ইতিহাসেও রয়েছে কাঁটার মতো হুল ফোটানো কিছু ঘটনা। ফুল নাকি কাঁটা—আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতির লক্ষ্য কী হবে, এর ওপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বহুলাংশে।
ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সাহসী ও সফল দল। প্রায় জন্মক্ষণ থেকে দলটি ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে দিয়েছে, শৈশবেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম দল হিসেবে নিজের অবস্থান করে নিয়েছে এবং প্রখর তারুণ্যে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এ দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলের সাফল্য নির্ভর করে মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারার মধ্যে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মতো সফল দলের নজির উপমহাদেশে কম রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বকালেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে বিভিন্ন সময়। ১৯৮৬ সালে এরশাদের সংসদ থেকে বেরিয়ে আসা, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে নেতৃত্বদান, ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ—এসবের মধ্যে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল।
নিয়তি হচ্ছে, আওয়ামী লীগের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের মনের ভাষাকে বোঝার বিষয়টিই। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো মধ্যবর্তী নির্বাচন নেই, ফ্রান্সের মতো এমপিদের রিকল করার ব্যবস্থা নেই, ব্রিটেনের মতো অনাস্থা প্রস্তাবের অবাধ সুযোগ নেই, এমনকি ভারতের মাপেরও নির্ভরযোগ্য জরিপ নেই। এখানে মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারার একমাত্র উপায় হচ্ছে পাঁচ বছর মেয়াদি সংসদ নির্বাচন। কিন্তু এই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন শূন্যের কোঠায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের অতি বিতর্কিত ঘটনাবলির জন্য।
২০১৪ সালে তবু বিরোধী দলের ওপর নির্বাচন বর্জনের দায় বর্তানোর সুযোগ আওয়ামী লীগের ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেই সুযোগও ছিল না। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং এরপরের বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে ভয়াবহ অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ করেছে খোদ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটসঙ্গীদেরও অনেকে। মনে হচ্ছে, এসব বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনের উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের মনের ভাষার প্রতি ভীতি, সেটি আমলে নেওয়ার তীব্র অনিচ্ছা।
আওয়ামী লীগ বরং এ সময় ক্ষমতায় থাকার বৈধতা তৈরির চেষ্টা করেছে ‘উন্নয়ন’– এর রাজনীতির কথা বলে। অল্প সময়ে বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, রপ্তানি ও প্রবৃদ্ধির উন্নয়ন ঘটিয়ে নাগরিক সমাজের সুশাসনের আকাঙ্ক্ষা এবং বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নগুলো গৌণ করতে আওয়ামী লীগ সরকার কিছুটা সফলও হয়েছিল। কিন্তু সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন যে কতটা ঠুনকো, তা দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক দুরবস্থায় স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় উন্নয়নের সেই রাজনীতিতে এখন ভাটার টান পড়েছে। উন্নয়নের আলোকসজ্জায় মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া দলটিকে এখন দুর্ভিক্ষের জন্য প্রস্তুত থাকার সতর্কতা জানাতে হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের টিকে থাকার আরেকটি বড় অস্ত্র অবশ্য এখনো রয়ে গেছে। সেটি হচ্ছে বিরোধী দল ও ভিন্নমতকে হেনস্তা করা। জঙ্গি, পাকিস্তানপন্থী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীর বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে এবং র্যাব-পুলিশ-বিচার বিভাগ ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো কালো আইনগুলোকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ এদের অবস্থানকে দুর্বল করতে এখনো সচেষ্ট রয়েছে। এসবের সঙ্গে সঙ্গে গত এক দশকে বিরোধী দলগুলোর অনৈক্য এবং বিশেষ করে বিএনপির দুর্বলতা আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক হয়েছে।
সমস্যা হচ্ছে আওয়ামী লীগের এসব কৌশলগত শক্তি এখন আর আগের মতো ধারালো নেই। গত দু-এক বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ, র্যাব-পুলিশের কিছু কর্মকর্তার ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা, রোহিঙ্গা ও ইউক্রেন সংকটের পর আন্তর্জাতিক রাজনীতির মেরুকরণের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক নজরদারি ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চাপ অনেক বেড়েছে। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও বড় প্রকল্পে চীনের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ ভারতের সঙ্গে কিছুটা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছে।
আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনা হয়ে দেখা দিয়েছে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা। জ্বালানিসংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংকে তারল্যের সংকট, রিজার্ভের অবনতিশীল পরিস্থিতি এবং সামনের বছর থেকে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ধাক্কা ভবিষ্যতে সামাল দেওয়া সহজ হবে না। এমন পরিস্থিতিতে এমনকি শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়াও মানুষের ক্ষোভের তোপে আপাতত শক্তিশালী একটি সরকার কীভাবে ভেঙে পড়ে, তার নজির আমরা দেখেছি শ্রীলঙ্কায়।
এমন এক সংকটকালে আওয়ামী লীগ কি আবারও বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনের ঝুঁকি নেবে? জঙ্গিবাদের আশঙ্কা উসকে দিয়ে, অন্য কিছু দলকে নানাভাবে প্রভাবিত করে এবং বিএনপির ওপর আরও কঠোর দমননীতি চালিয়ে এমন নির্বাচন আয়োজন কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। তবে এতে দলটির ক্ষমতায় টিকে থাকা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। দলটি যে জনগণের মনের
ভাষা বিবেচনায় নিতে অনিচ্ছুক এবং জনগণের ভোটের অধিকারের প্রতি তাদের অবজ্ঞা যে এত চূড়ান্ত তা আরও স্পষ্ট হবে। রাজনৈতিক হানাহানি, অনৈক্য ও অস্থিতিশীলতায় দেশের স্বার্থ হবে
আরও বিপন্ন।
বিকল্প হিসেবে সব মহলের সঙ্গে বসে আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনের স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ঠিক করতে পারে, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে এবং কঠোরভাবে দুর্নীতি দমনের পদক্ষেপ নিতে পারে। এটি ঠিক যে আওয়ামী লীগ তারপরও আগামী নির্বাচনে ক্ষমতা হারাতে পারে এবং পরবর্তী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের শিকার হতে পারে। কিন্তু জনগণের মনের ভাষাকে সম্মান করার তার যে দীর্ঘ ঐতিহ্য, তা এতে ফিরে আসবে, জনগণ আস্থা ফিরে পেলে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসতে পারবে।
ক্ষমতার পালাবদলের সুষ্ঠু প্রক্রিয়া নির্বাচনী কারচুপির অসৎ প্রচেষ্টার চেয়ে দেশের স্বার্থের জন্য অনেক বেশি মঙ্গলজনক। ১৯৯১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। তুলনামূলক যেকোনো বিচারে এটাই ছিল বাংলাদেশের অগ্রগতির শ্রেষ্ঠ সময়।
সদিচ্ছা থাকলে আওয়ামী লীগ আবারও বাংলাদেশকে ভালো একটি সময়ে নিয়ে যেতে পারবে। আবারও পারবে ফুলের সুবাস ছড়াতে।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক