অমিয়ভূষণ মজুমদারের মহিষকুড়ার উপকথা উপন্যাস দিয়েই লেখাটা শুরু করা যাক। মহিষকুড়া এমন এক গ্রাম, যেখানে ‘বিচ্ছিন্নতাকে চোখের মণির মতো রক্ষা করে’ গ্রামের বাসিন্দারা। তবে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে গ্রামটি। যন্ত্রশাসিত সভ্যতা যতই এগিয়ে আসতে থাকে, ততই হারিয়ে যেতে থাকে মহিষকুড়ার প্রাচীন ঐতিহ্য বনবাদাড়, গাছপালা আর বাথান। গ্রামের বাথান বালক আশফাক কখনো কোনো যন্ত্র দেখেনি। তাই গ্রামে প্রথমবারের মতো ট্রাক আসতে দেখে সে ভাবে, এ–ও বুঝি একধরনের ‘কলের মহিষ’।
‘মহিষকুড়া’ গ্রামের এই পরিণতির সঙ্গে চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন জাহাজ নির্মাণশিল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু ‘কলের মহিষের’ জায়গায় ‘কলের জাহাজ’ বসিয়ে ভাবতে গেলে একটা মিল ধরা পড়বেই। বিশ্বের সেরা জাহাজ নির্মাণশিল্প কী করে গড়ে উঠল এই চট্টগ্রামে, এই ইতিহাস অনেকেরই জানা। তবে কেন তা রক্ষা করা গেল না, সে উত্তরও আমরা পেয়ে যাই অমিয়ভূষণের উপন্যাসের চরিত্র আশফাকের ট্রাক দেখার অভিজ্ঞতা থেকে। কেমন ছিল এই শিল্প? সংক্ষেপে সেটাই জেনে নেওয়া যাক।
চট্টগ্রামের মালুম ঘাট, ইশানমিস্ত্রির হাট কিংবা বালামীপাড়া নামগুলো এখনো প্রাচীন জাহাজ নির্মাণশিল্পের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এসব এলাকার রাস্তা ধরে হাঁটলে অতীতের ব্যস্ততা আর চোখে পড়বে না। তবে ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যাবে ছেনি, হাতুড়ি আর বাটালির শব্দ। কয়েক শতাব্দী ধরে টিকে থাকা এই শিল্প ব্রিটিশ শাসনামলে এসে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। শিল্পটির স্বর্ণযুগ কেমন ছিল, তার প্রত্যক্ষ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না ইতিহাস ঘেঁটে। তবে অবক্ষয়ী যুগে অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনামলের কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। চট্টগ্রামে কাঠের জাহাজ ভাসানোর তেমনই এক বিবরণ লিখে গেছেন বিখ্যাত ইংরেজ লেখক ও প্রশাসক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার।
আমেনা খাতুন ও জামেনা খাতুন
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার তাঁর বইতে লিখেছেন, ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দ অবধি জাহাজ নির্মাণশিল্পে চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় ছিল। এই শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রথম মহাযুদ্ধের আগে চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গি বাজারের দোভাষ পরিবারেরও বড় জাহাজ ছিল। আবদুর রহমান দোভাষ ছিলেন প্রথম সারির জাহাজমালিক। ১৯১৪ সালে আবদুর রহমান দোভাষ তাঁর দুই মেয়ে আমেনা খাতুন ও জামেনা খাতুনের নামে দুটি জাহাজ তৈরি করিয়েছিলেন। জাহাজ দুটির দৈর্ঘ্য ছিল ৮০ ফুট। তৈরিতে খরচ হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা। জাহাজ দুটির প্রধান মিস্ত্রি ছিলেন হালিশহর বালামীপাড়ার কালীপদ মিস্ত্রি। ১৯১৪ সালের ১৫ মার্চ এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমেনা খাতুন নামের প্রথম জাহাজটি জলে ভাসানো হয়।
সে বিবরণ দিতে গিয়ে হান্টার সাহেব লেখেন, সেদিন আমেনা খাতুনের জলে ভাসানোর দৃশ্য দেখতে কর্ণফুলী নদীর তীরে হাজারো মানুষের সমাগম হয়েছিল। প্রচুর বাজি ফোটানো হয়েছিল সেদিন। সঙ্গে বাজছিল ঢোল। জাহাজ ভাসানো উপলক্ষে জেলে নারীরা ‘বরণ ডালা’ নিয়ে জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন। নদীতীরবর্তী উঁচু একটি ভূমিতে সেই জাহাজ নির্মিত হয়েছিল। বেলা তিনটার সময় কর্ণফুলী পূর্ণ জোয়ারে ভরে উঠলে মিস্ত্রিরা ক্রমে ক্রমে সব কটি ঠেকনা ফেলে দিলেন। সেখানে উপস্থিত এক ইংরেজ ডাক্তার দম্পতি দুধে ভরা দুটি বোতল পানিতে ভাসিয়ে দিতেই প্রধান মিস্ত্রি একটি হাতুড়ির আঘাতে জাহাজকে ঠেকিয়ে রাখা চাবি ভেঙে দিলেন। এক মিনিটের মধ্যে জাহাজ জলে পড়ল।
সরের জাহাজ
চট্টগ্রামের কাঠের পালতোলা মজবুত জাহাজের সুখ্যাতি ছিল পৃথিবীজোড়া। এ কথায় কণা পরিমাণ অতিশয়োক্তি নেই। ইউরোপীয় ভ্রমণকারী সিজার ফ্রেডারিক ১৫৬৭ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম ভ্রমণে আসেন। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, মিসরের আলেকজান্দ্রিয়াতে তখন চট্টগ্রামে তৈরি জাহাজ রপ্তানি করা হতো। সারা বিশ্বে প্রতিবছরই সে সময় চট্টগ্রামে তৈরি ২৫ থেকে ৩০টি জাহাজ রপ্তানি হতো। ও এম মার্টিন রচিত হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড সূত্রে জানা যায়, ১৯০৫ সালের বিশ্ববিখ্যাত ট্রাফালগার নৌযুদ্ধে চট্টগ্রামে নির্মিত জাহাজ ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৮১৮ সালে জার্মান সরকার চট্টগ্রাম থেকে একটি সরের জাহাজ নির্মাণ করিয়ে নিয়েছিল। জার্মানিতে নেওয়ার পর তারা সে জাহাজটির নাম দিয়েছিল ‘ডয়েচল্যান্ড ফ্রিগেট’। ওই জাহাজটি বর্তমানে জার্মানির ব্রেমাহাফেন শিপ বিল্ডিং মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। জানা গেছে, এই জাহাজ এতই বিখ্যাত যে সেখানকার একটি চীনামাটির জিনিসপত্র নির্মাতা কোম্পানি তাদের তৈরি জিনিসপত্রে ডয়েচল্যান্ড ফ্রিগেটের ছবি মনোগ্রাম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
চট্টগ্রামের এই পালতোলা কাঠের জাহাজের নাম ছিল সরের জাহাজ। ‘সর’ আরবি ভাষার শব্দ। এর অর্থ পাল। চট্টগ্রামে আরবের প্রভাবের কারণেই পালতোলা জাহাজের এমন নামকরণ বলে আবদুল হক চৌধুরীসহ ইতিহাসবিদেরা মনে করেন।
বন্দর শহর চট্টগ্রাম বইতে আবদুল হক চৌধুরী লিখেছেন, সেকালে জাহাজ নির্মাণের প্রধান উপকরণ লোহাকাঠ, সেগুন ও জারুল চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ ছিল বলেই প্রাচীনকাল থেকে এখানে জাহাজ নির্মাণশিল্প গড়ে উঠেছিল। আবদুল হক চৌধুরীর বই থেকে আরও জানা যায়, চট্টগ্রামের জাহাজ নির্মাণশিল্পের কারিগরদের বসবাস ছিল ডবলমুরিং থানার হালিশহর গ্রামের বালামীপাড়ায়। পাড়াটি ছিল হিন্দুপাড়া। এ ছাড়া আগ্রাবাদের কিছুসংখ্যক মুসলমানও এই পেশায় কাজ করতেন। বালামীপাড়ার কারিগরেরা ছিলেন নিরক্ষর, কোনো প্রকৌশলজ্ঞান ছিল না তাঁদের। করাত, হাতুড়ি, বাটালি দিয়ে কোনো নকশা ছাড়াই জাহাজ বানাতে পারতেন কারিগরেরা। সেকালের চট্টগ্রামের সরের জাহাজের কাপ্তানদের মধ্যে নসু মালুম, আবদুল মালুম, গুমানী মালুম, আসদ আলী মালুম, আকবর আলী মালুমের নাম এখনো এই নগরের বয়স্ক লোকজন জানেন। শহরের কিছু এলাকা ও রাস্তাও রয়েছে তাঁদের নামে। সেকালের সরের জাহাজের নিরক্ষর অথচ অভিজ্ঞ মালুমেরা প্রথম যুগে আকাশের নক্ষত্র দেখে পরবর্তীকালে একটিমাত্র দিগ্দর্শনযন্ত্রের সাহায্যে সাগরে জাহাজ পরিচালনা করতেন।
জাহাজমালিকদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন দেওয়ান আলী, মদন কেরানি, জগমোহন মহাজন, রৈঙ্গা বসির, জব্বর আলী, কোরবান আলী, আবজান বিবি, আসমত আলী, দাতারাম চৌধুরী, রামমোহন দারোগা, কিশোরী মোহন সেন, পিরু সওদাগর, শরীয়তুল্লাহ সওদাগর, রামসুন্দর সেন ও এয়াকুব আলী দোভাষ।