রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা

আহমদ ছফা: বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্রপ্রকল্প

জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।

আহমদ ছফা (৩০ জুন ১৯৪৩—২৮ জুলাই ২০০১)
আহমদ ছফা
(৩০ জুন ১৯৪৩—২৮ জুলাই ২০০১)

আহমদ ছফার প্রধান অবদান বাংলাদেশের জন্য একটি রাষ্ট্রপ্রকল্প হাজির করা। ছফার জন্য এই চেষ্টা ছিল স্বাভাবিক, যেহেতু তিনি ভাবতেন, ‘মানুষের যাবতীয় সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রাষ্ট্রই হলো সর্বাধিক গুরুত্বসম্পন্ন,’ এবং হেগেল থেকে শিখেছিলেন, কোনো সমাজের সাবালক হওয়ার প্রাকশর্ত রাষ্ট্রগঠন। ছফার রাষ্ট্রপ্রকল্প যে চিন্তার ইতিহাসের মধ্যে প্রথিত ছিল, তার বনিয়াদি কথাটা—‘স্বতন্ত্র কৃষ্টির মানুষ স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিদার’—উনিশ শতক থেকেই চালু ছিল, কিন্তু এটা বিশ্বরাজনীতির অ্যানথেম হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, উড্রো উইলসন যখন ‘স্বাধিকার’-এর সন্ত পুরুষ হিসেবে নাজিল হলেন। দীর্ঘ ষাটের দশকে আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে ‘ডিকলোনাইজেশন’ ও ‘স্বাধিকার’-এর যে ঝোড়ো হাওয়া, সেটাই ছফার রাষ্ট্রপ্রকল্পের নগদ প্রেক্ষিত। ছফার তাই প্রথম কাজ ছিল ইতিহাসের পলিস্তরের মধ্যে নানা বিভঙ্গে ঘাপটি মেরে থাকা জাতিসত্তার হদিস দেখানো। অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আর মুসলিম জাতীয়তাবাদের সেই যুগে বঙ্গীয় জাতিসত্তা দেখতে পাওয়ার কাজটা মোটেই সোজা ছিল না। ছফার এই জাতিসত্তা—যা রাষ্ট্র কায়েমের প্রথম ধাপ—ছিল ‘সজাগভাবেই’ বাঙালি মুসলমানের চোখ দিয়ে দেখা। এর কিছু অনুষঙ্গ পাকিস্তানবাদী বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের থেকে পাওয়া হলেও এর সবচেয়ে সার্থক প্রতিভূ, ছফার বিচারে, দীনেশচন্দ্র সেন।

‘বাঙালির যে একটি আলাদা জাতিসত্তা রয়েছে’—পাকিস্তান যুগে সেটা শুধু মনে রেখেছিল বামপন্থীরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভাঙনের ফলে ছফা লিখছেন, পূর্ব পাকিস্তান ‘ন্যাপ’ মস্কো আর পিকিং দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়ল। পিকিংবাদীরা হলেন আইয়ুব খানের মুরিদ, যেহেতু তিনি চীনের বন্ধু। আর মস্কোবাদীরা টেকনাফ থেকে খাইবার পাস-তক সমাজতন্ত্রের খোয়াবে বেহুঁশ। এই অবসরে আওয়ামী লীগ—মোটাদাগে এত দিন স্বাধিকারের বিরোধী (লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দীর ভাষায়, পূর্ব পাকিস্তান ‘আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন’ তো পেয়েই গেছে!)—রাতারাতি টু-ইকোনমি থিসিসভিত্তিক ছয় দফার আন্দোলন করে স্বাধিকারের মাহুত হিসেবে জাহের হলো।

এই ছয় দফা আন্দোলনের মধ্যে ছফা দেখতে পেলেন একটি জাতিসত্তার অলক্ষ্যে জেগে ওঠা, যা নিস্তরঙ্গ সময়ে ইতিহাসের পলিস্রোতের নিচে ম্রিয়মাণ বইতে থাকে। এই সত্তাটাকে ভাষার মধ্যে ধরার একটা ‘অ্যানালিটিক’ ছিল ছফার: এর প্রস্থানবিন্দু হচ্ছে বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুরাষ্ট্র এবং অখণ্ড ভারতের ধারণা—যার স্ফুলিঙ্গ আছে দেবী চৌধুরাণীতে, কিন্তু যেটি অগ্নিগিরি হয়েছে আনন্দমঠ-এ। ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের মিলিত বিদ্রোহকে আনন্দমঠ শুধু সন্ন্যাসীদের লড়াই হিসেবে আঁকে; আর এই সেপারেটিস্ট ন্যারেটিভই, ছফার মতে, বাংলাভাগের জন্য দায়ী। এই হিন্দু্ত্ববাদী রাষ্ট্রপ্রকল্পের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে একটি বঙ্গীয় জাতিসত্তার ধারণা, যার সবচেয়ে দানেশমন্দ দ্রষ্টা দীনেশচন্দ্র। ‘বঙ্কিম যে সমাজচিন্তা’কে তাঁর রচনায় আদর্শ করেছেন, দীনেশচন্দ্র সারা জীবনের কাজের ভেতর দিয়ে, নীরবে, ‘তার একটা বিপরীত যুক্তি নির্মাণ করেছিলেন।’ বঙ্কিমের রাষ্ট্রপ্রকল্প অখণ্ড ভারতের ওপর কেন্দ্রীয় শাসন চাপিয়ে দেওয়ার প্রকল্প। বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রতে শিশুপাল, জরাসন্ধ এসব রাজাকে হত্যা করে কৃষ্ণ ধর্মসম্মত কাজ করেছেন, কিন্তু দীনেশচন্দ্র জরাসন্ধের চরিত্রে খুঁজে পেয়েছেন ‘বৃহৎ বঙ্গের ক্ষাত্রনীতি’। কৃষ্ণকে আশ্রয় করে উত্তর-পশ্চিমে ব্রাহ্মণেরা যে নতুন হিন্দুসমাজ গঠন করেছিলেন, ‘পূর্বদেশের সার্ব্বভৌম রাজারা তাহার ঘোরতর বিরুদ্ধতা’ করে কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বলে দীনেশবাবুর চোখে তাঁরা ‘দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাপ্রেমিক বীর’।

শুধু দীনেশচন্দ্র নন, এই রাষ্ট্রপ্রকল্পের উদাহরণ হিসেবে ছফার কাছে ধরা দিয়েছেন নানা বর্গের মানুষ। জয়নুলের চিত্রপটে এই জাতিসত্তার হাজার বছরের ইতিহাস দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। ইলিয়াসের খোয়াবনামা—ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের জমিনে লেখা—বঙ্কিমের ‘ফলস ডিসকোর্স’ ভেঙে দিয়ে হাজির করেছে নতুন বয়ান, যেখানে ‘বাঙলার হিন্দু-মুসলমান যৌথভাবে ইতিহাসের’ কর্তা। এই রাষ্ট্রকল্পনার পেছনে আছেন জীবনানন্দ দাশও, যিনি দীনেশবাবুর মতো, বাংলার লোকজ ঐতিহ্যের কাব্যিক রূপ দিয়েছেন। জসীমউদ্​দীন ‘লোক ঐতিহ্যের মাংস গ্রহণ করেছেন মাত্র,’ আর জীবনানন্দ করেছেন ‘হাড়-মাংস ছেনে তারপর প্রাণ’। তাঁর তীক্ষ্ণ ইতিহাসবোধের স্পর্শে জিন্দা করেছেন ‘আপন মাতৃভূমির ইতিহাস।’

ছফার এই রাষ্ট্রপ্রকল্প ‘সজাগভাবেই’ মুসলমানের চোখে দেখা; ছফা নিজেকে ভাবতেন মুসলমান চাষা-সমাজের শরিক, আর যে বঙ্গীয় জাতিসত্তার তিনি ভাষ্যকার ছিলেন, তার ‘আশি শতাংশের মতো মানুষ মুসলমান’। স্বভাবতই তিনি পাকিস্তানবাদী রাষ্ট্রচিন্তার কাছে ঋণী ছিলেন কিছু দূর। এই উপমহাদেশে, আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখলেন, ‘একটা জাতি কখনও ছিল না—এখনো নাই। কাজেই ভারত যেমন এক দেশ নয়, তেমনি ভারতবাসী এক জাতিও নয়।’ আবুল মনসুর আহমদ দেখাতে চেষ্টা করলেন যে ঠিক কোন অর্থে পাকিস্তানের দাবি একটা বিপ্লবী ঘটনা। সাম্যবাদের মূলকথা আত্মবিকাশের সুযোগ করে দেওয়া, যে বিকাশ স্বভাবতই একরূপী নয়, বরং বহুরূপী বা মাল্টিফর্ম। কিন্তু ফ্যাসিবাদ বৈচিত্র্যকে মুছে দুনিয়াকে একবগ্গা করতে চায়। ভারতবর্ষের ‘চল্লিশ কোটি আদম-সন্তানকে “একজাত” বলে ঘোষণা’ করার যে সাম্রাজ্যবাদী চেষ্টা কংগ্রেসের নেতৃত্বে হচ্ছে, মনসুর লিখলেন, ‘পাকিস্তানই সে সাম্রাজ্যবাদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।’ সাহিত্যিকের কাছে পাকিস্তানের অর্থ তমদ্দুনী আজাদি—যার অর্থ হচ্ছে, রাজনীতির ক্ষেত্রে যা-ই হোক, ‘সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমানরা আলাদা জাত।’ এই আজাদির জন্য এটা বোঝা জরুরি যে বিদ্যাসাগর থেকে শরৎচন্দ্র পর্যন্ত যে বাংলা সাহিত্য সেটা মুসলমানের সাহিত্য নয়। তেমনি এটাও সত্যি, মনসুর নোকতা দেন, যে পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তান এক তমদ্দুন নয়। কারণ, তমদ্দুনের মধ্যে ধর্ম লুকিয়ে থাকলেও তমদ্দুন ভূগোলের সীমা এড়াতে পারে না।

মনসুর পাকিস্তান যুগের নুমায়েন্দা, আর ছফা মুক্তিযুদ্ধ জমানার—এ রকম অনুমানের মধ্যে ধর্ম ও ভাষাকে যেভাবে জল-অচল, কংক্রিট—বা ‘রিইফাই’—করে তোলা হয়, যার ফলে জাতিসত্তার ন্যারেটিভে দেখা দেয় ‘অ্যাপরিয়া’—বা ‘যৌক্তিক কূটাভাস’—যেখানে ‘বাঙালি’ আর ‘মুসলমান’ হাজির হয় দুটো আলাদা, সমীচীন, অথচ সাংঘর্ষিক এনটিটি হিসেবে, ছফা যেন সেটাকে কবুল করেন একটি তৃতীয় পাটাতন খুঁজবেন বলে। ভাষা জাতি-গঠনের একটি মৌলিক উপাদান হলেও ভাষার সীমা আছে; আর ইসলামের কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়েছে যাঁরা বলেন তাঁরা ভুলে যান, ‘ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো’ ভাঙার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে। ভাষা ও ধর্মের অ্যাপরিয়া ঘোচাতে দরকার একটি তৃতীয় পাটাতন, ছফা যার নাম দেন ‘যৌথ আকাঙ্ক্ষা’। বাঙালি মুসলমান কারা? ছফার মশহুর, কিন্তু কার্যত গৌণ এবং বিভ্রান্তিকর লেখা, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ মোতাবেক: ‘ইতিহাসের আদি থেকেই নির্যাতিত একটি মানবগোষ্ঠী,’ যারা প্রথমে বৌদ্ধমত এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করে ব্রাহ্মণবাদের পীড়ন থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। যেহেতু সংখ্যাগত বিচারে তারা ছিল অনেক, আর ছিল মুসলমান, তাই মুসলিম-রাজত্বের সময় তাদের মানসে ‘একটি বলবন্ত সামাজিক আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিল।’ এই ‘দলিত,’ ‘মেহনতি’ মুসলমান সমাজের একটি যৌথ-চেতনা থাকলেও ‘তাঁর মানসিকতার মধ্যে’—আফসোসের কথা—‘আদিম সমাজের চিন্তনপদ্ধতির লক্ষণসমূহ সুপ্রকট।’ বিমূর্ত চিন্তা করতে পারার সামর্থ্যের অভাবে উন্নত বিজ্ঞান, দর্শন এবং সংস্কৃতির স্রষ্টা হওয়ার কুদরত তার নেই, তাই ‘তাকে দিয়ে উন্নত রাষ্ট্র সৃষ্টিও করা সম্ভব নয়।’ জাতিসত্তার মুক্তির জন্য চিন্তার সাবালকত্ব খুব জরুরি ছিল ছফার বিচারে। ডু বয়েসের ‘ট্যালেন্টেড টেনথ’-এর মতো একটি হিউম্যানিস্টিক অনুমান ছিল ছফার—যে, ব্যক্তির চিন্তার, কল্পনার বিকাশ থেকেই সমষ্টির মুক্তি আসে। ছফার আঁকা দলিত, মেহনতি মানুষটি চিন্তার দিক থেকে দরিদ্র বলে এবং পুঁথিসাহিত্যের অনুরাগী বলে, অচিরেই তার মুক্তির পথ নেই।

এই হতাশাবাদের বিপরীতে ছফার অন্যান্য লেখার মধ্যে খুব বিপরীত একটা ছবি ধরা পড়ে। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে, কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের অংশী বলেই মুসলিমরা আদিম, প্রতিক্রিয়াশীল ও হীনম্মন্য। কিন্তু ছফার সুলতানকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধে: কৃষি আমাদের সভ্যতার প্রাণ, আর কৃষাণ তার একক কুশীলব; সুলতানের কৃষক তাই বাংলাদেশের হয়েও ‘সমস্ত পৃথিবীর’। বাঙালি মুসলমানের সৃষ্টিশীলতারও—যার প্রত্যুষা ‘...মন’ প্রবন্ধে এক সুদূরপরাহত ব্যাপার—নানা রকম উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে এখানে। তরুণ জয়নুল তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাকের ছবির মধ্যে পঞ্চাশের ‘মন্বন্তরের সমস্ত ভয়াবহতা’ এমনভাবে মূর্ত করে তুললেন, যা অবনীন্দ্র-যামিনী-নন্দলালের মতো মহান শিল্পীদের দ্বারা কোনো দিন হতো না। জয়নুলের আবির্ভাব কোনো আকস্মিক, খাপছাড়া ঘটনা ছিল না। আব্বাস-জসীম-জয়নুল-বুলবুল নানা রকম স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও ‘কোথায় যেন একই সূত্রে বাঁধা,’ তাঁরা সমাজ-সংস্কৃতির এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান করে তুলেছেন, ‘যার বোধটি পর্যন্ত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুর ছিল না।’ অথচ তা এ দেশেরই, ‘কর্মজীবী মানবগোষ্ঠীর...উত্তরাধিকার।’ জসীমউদ্​দীন ‘এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে’ কবিতায় যে দ্রাবিড় পুরুষের ছবি আঁকেন, বা ‘গদাই নমুর কালো মেয়ে’র যে সৌন্দর্য তুলে ধরেন, তার মিছাল রামায়ণ-মহাভারত, মুকুন্দরাম বা ইরানি-তুরানি উপকথায় নেই। অথচ এই সুন্দরেরা শুরু থেকে ‘আমাদের ইতিহাস আলো করে আছে।’ বাঙালি মুসলমান শিল্পীর চোখ সৌন্দর্য আবিষ্কার করেছে ‘শ্রমনিষ্ঠ মানুষ-মানুষীর মধ্যে’। মেহনতি, দলিত বাঙালি মুসলমান এখানে ‘আদিম’ নয়, ‘আলাদা’—তার ভিন্নতাই তাকে ভূষিত করেছে এক ভিন্ন সৃষ্টিশীলতায়।

খেটে খাওয়া এসব মানুষের একটি রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ভাবনা তুলে ধরেছিলেন আহমদ ছফা

অন্যত্র ছফা খেয়াল করেছেন যে বাংলার সংস্কৃতির নির্মিতির পর্বে মুসলমানের তুলনীয় অবদান ছিল না, কিন্তু ‘ভাষা আন্দোলন বাঙালী জাতির ইতিহাসের নবযুগের প্রবেশপথের তোরণদ্বার,’ যখন ‘বাংলাদেশের আদিম সৃষ্টিশক্তির হাজার বছরের রুদ্ধ উৎসমুখ প্রবল একটা ভূমিকম্পে খুলে গিয়েছিল।’ এই সৃষ্টিমুখর তরঙ্গপ্রবাহে রপ্ত করা রুচির রেশমি মসৃণতা আর ইসলামি অনুশাসনের মহিমা—দুটোই ছিল অনুপস্থিত; কলকাতার কোনোরকম অনুকরণও বলা যাবে না একে। এটা ছিল ‘আবহমান কালের বাংলার সংস্কৃতির স্তন্যরসে পুষ্ট।’ উপন্যাসে আবু ইসহাক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ; গল্পে শাহেদ আলী, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক; কবিতায় সিকানদার আবু জাফর, সানাউল হক, আবদুল গণি হাজারী; আর স্থির মনন এবং যুক্তিশীলতায় শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী। ‘এক-একটি দিনে ছয় মাসের পথ অতিক্রম করছিল এমন তীব্র তার গতিবেগ।’

ষাটের দশকে এই বাঙালি জাতিসত্তার সামনে, ছফা খেয়াল করেন, দুটো রাস্তা খুলে গিয়েছিল। ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে সংগ্রামের যে ধারাটি হাজির, তার সঙ্গে ভারতের শোষিত অঞ্চলগুলোর সংগ্রামের ‘একটা সাযুজ্য...একটা প্রবাহমানতা অনায়াসে আবিষ্কার করা যায়।’ উদাহরণ হিসেবে ছফা ভাষা আন্দোলনের কথা বলেন, যার অল্পকাল পরেই ‘হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তামিল ভাষাভাষী অঞ্চলে...আন্দোলন এবং বিক্ষোভ সংগঠিত হয়।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের রাজ্যগুলোয় নতুন করে স্বায়ত্তশাসনের বিক্ষোভ ‘ভারতীয় ইউনিয়নের ঐক্যের ভিতটিকে কাঁপিয়ে তুলেছে।’ জাতিসত্তার এই প্রথম ন্যারেটিভের সারকথা হচ্ছে, ‘ভারতবর্ষ হিন্দু-মুসলমান দু’জাতির দেশ নয়। ভারত বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দেশ।’

দ্বিতীয় ন্যারেটিভে—যেটি ছফার মতে, ভারতীয় কংগ্রেসের তাত্ত্বিকদের হাতে তৈরি—বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভুল সংশোধন হিসেবে দেখা হয়। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের উপর, ছফা আফসোস করেন, এই ন্যারেটিভের প্রভাব পড়েছিল। নেহেরু কোটের আদলে ‘মুজিব কোট,’ দেশবন্ধু ছাঁচে ‘বঙ্গবন্ধু’ এস্তেমাল করে, ছয় দফার শেষ পর্বে অহিংস অসহযোগ ঘোষণা করে, শেখ মুজিব ‘ভারতীয় জনগণের দৃষ্টিতে মহাত্মা গান্ধীর মানসপুত্র হিসেবে দেখা দিলেন।’ এই দ্বিতীয় ন্যারেটিভ গ্রহণ করেছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু—যিনি বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য ‘আর দাবায়ে রাখবার পারবা না’-এর রচয়িতা—সময়ের স্রষ্টা হতে পারেননি, সময়ের ফসল হয়ে রয়ে গেলেন।

বাংলাদেশের জন্য একটি সর্বজনীন এবং ইতিহাসনিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রকল্প হাজির করতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো ছফা আরও অনেককাল আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক থেকে যাবেন।

তৈমুর রেজা: বাঙালি মুসলমানের ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশ–উত্তর ইতিহাসের গবেষক; পোস্টডক্টরাল ফেলো, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়