কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন শরৎকুমার রায়। ছাত্রজীবন শেষ করে ইউরোপ সফরে গিয়েছিলেন নাটোরের দীঘাপাতিয়ার এই রাজকুমার। ঘুরেছেন ইতালির পম্পেই, গ্রিসের থিবস। মিসরের অনেক প্রাচীন শহরেও পড়েছিল তাঁর পা। এসব নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখে নিজের দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন তিনি। দেশে ফিরে ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতি বরেন্দ্র অঞ্চলের পুরাকীর্তি অনুসন্ধানে নেমে পড়ে। সমিতির সংগ্রহ নিয়ে ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বরে যাত্রা শুরু করে ‘বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম’। অগ্রজ রাজা প্রমদানাথের দেওয়া জমিতে নিজের পকেট থেকে ৬৩ হাজার টাকা দিয়ে গৌড়ের স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে অপূর্বশিল্প সুষমামণ্ডিত একটি ভবন নির্মাণ করান শরৎকুমার রায়। জানা যায়, এর নকশাও শরৎকুমার রায় নিজেই করেছিলেন। দেশের একমাত্র গবেষণা জাদুঘরটি ১৯৬৪ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে এই জাদুঘরের সংগ্রহে আছে ১৭ হাজারের বেশি দুর্লভ সংগ্রহ।
জাদুঘরে ঢুকেই দর্শনার্থীরা প্রথম প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে পরিচিত হবেন। প্রথমেই অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ছবি। তিনি ছিলেন বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির পরিচালক। মাঝখানে শরৎকুমার রায়ের ছবি। তিনিই ছিলেন সমিতির সভাপতি। তারপর আছে জাদুঘরের প্রথম অনারারি কিউরেটর রমাপ্রসাদ চন্দের ছবি।
এরপর গ্যালারিতে ঢুকতেই দেখা মিলবে টেরাকোটার বিষ্ণুমূর্তি। পোড়ামাটিতে তৈরি হলেও এখনো অটুট আছে বিষ্ণুমূর্তিটির নিটোল চোখমুখ। জাদুঘরের একজন কর্মকর্তা বলেন, টেরাকোটায় তৈরি আরও দুটি মূর্তি ঢাকা জাদুঘরে ছিল। ২০০৭-০৮ সালে ফ্রান্সের গিমে জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য বিমানবন্দরে নেওয়ার পর সেখান থেকে মূর্তি দুটি চুরি হয়ে যায়। পরে ভাঙা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তারপর নওগাঁর রানীনগর থানায় বিষ্ণুমূর্তিটি পাওয়া যায়। এটিই এখন দেশে টেরাকোটায় তৈরি একমাত্র বিষ্ণুমূর্তি।
এরপরের গ্যালারিতেই দেখা যাবে লক্ষ্মণ সেনের বাগবাড়ী শিলালিপি। ‘কুটিল’ হরফে লেখা এই শিলালিপিতে লক্ষ্মণ সেনের রাজবংশের পরিচয় লেখা আছে। জাদুঘরের কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস বললেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ীর দেওপাড়া থেকে বিজয় সেনের ‘প্রশস্তি’ উদ্ধার হয়েছিল। সেটি কলকাতায় আছে। আর বাগবাড়ী থেকে ২০০৭ সালে পাওয়া লক্ষ্মণ সেনের এই লিপিটি এখানে রয়েছে। এটির সময়কাল ১১৮৪ থেকে ১১৮৫ সাল। এই লিপি আর কোথাও নেই।
ভেতরের একটি গ্যালারিতে রয়েছে গঙ্গামূর্তি। গঙ্গামূর্তি আরও বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে, কিন্তু এই মানের গঙ্গা আর কোথাও নেই বলে দাবি কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুসের। নারীদেহের সুঠাম গঠন ও পা থেকে মাথা পর্যন্ত গয়না আমাদের ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। মকরের (কুমিরের মতো প্রাণী) পিঠে আরোহণ করে আছেন গঙ্গা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখতে অনেকক্ষণ লাগবে। কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিত মূর্তিটি আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দীর। এটি জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা শরৎকুমার রায়ের সৌজন্যে পাওয়া।
এই গ্যালারিতেই রয়েছে অর্ধনারীশ্বর। অর্ধেক পুরুষ অর্ধেক নারী। শরীরের ডান দিকে পার্বতী, বাঁ দিকে শিব। ডান দিকে নারী অঙ্গের বৈশিষ্ট্য আর বাঁ দিকে পুরুষের চেহারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিত মূর্তিটি আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দীর।
জাদুঘরে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আছে। এগুলোর অধিকাংশ সংস্কৃত, প্রাকৃত ও আদি বাংলা ভাষায় রচিত। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯০০টি সংস্কৃত আর ১ হাজার ৭০০টি বাংলা। সবচেয়ে বেশি আলোচিত ১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দ এবং ত্রয়োদশ শতকের কোনো এক সময়ে তালপাতায় লিখিত ও রঙিন চিত্রকর্ম দ্বারা শোভিত দুটি পুঁথি। নাম ‘অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে অতি অনুসরণীয় ও সম্মানিত গ্রন্থ ‘অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’। আট হাজার লাইনে লেখা একটি পুঁথিতে ছয়টি ও অপরটির ৪৯টি পাতায় দেবদেবীর ৪৯টি রঙিন ছবি স্থান পেয়েছে। ছবিগুলোর রং-রেখা হাজার বছর পরও অটুট রয়েছে। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা পুঁথির চিত্র বাংলার প্রাচীন চিত্রশিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ ধরনের পাণ্ডুলিপি বা পাণ্ডুলিপির খণ্ডাংশ বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নেই।
জাদুঘরের নতুন ভবনে নিচতলায় আবহমান বাংলা ও মুসলিম ঐতিহ্যের নির্দশন স্থান পেয়েছে। এই ভবনেই অডিও ভিজ্যুয়াল গ্যালারির কাজ চলছে। জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক আলী রেজা মুহাম্মদ আবদুল মজিদ বললেন, এখানে প্রজেক্টরের মাধ্যমে একটি কক্ষে বড় মনিটরে সব গ্যালারির প্রত্নবস্তু দেখানোর ব্যবস্থা করা হবে। একসঙ্গে ৩০-৪০ জন দর্শনার্থী বসে প্রত্নবস্তু দেখতে পারবেন। আশা করা যাচ্ছে, এ মাসের মধ্যেই এই গ্যালারি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা যাবে।
জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন বৃহস্পতি ও শুক্রবার। জাদুঘর দেখার জন্য সম্প্রতি ১০ টাকা দর্শনী নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের লাগবে না। এ ছাড়া স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা এলে পরিচালক অর্ধেক দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শনী দেখার সুযোগ করে দিতে পারেন।
লেখক: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী