প্রথম আলোর ২৬ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, সোমবার। দিনটি আমার জীবনের জন্য বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। সেদিন শুরু হয়েছিল ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং এর পরেই ঘটেছিল এমন কিছু ঘটনা, যা চিরকাল আমার স্মৃতিতে রয়ে যাবে। সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এর পরের তিন দিন দেশে কার্যত ছিল না কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি।
আমি বাস করি বছিলা, মোহাম্মদপুরে, আর অফিস করি তেজগাঁওয়ে। পত্রিকার চাকরির কারণে আমাকে রাতে কাজ করতে হতো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর রাতগুলো হয়ে উঠল ভয়াবহ এবং অনিশ্চিত।
সরকার পতনের পরই শুরু হয় অরাজকতা। পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উধাও হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ আতঙ্কে ছিল, আর এই সুযোগে নেমে আসে অপরাধীরা। মোহাম্মদপুরের পথে পথে ছড়িয়ে পড়ে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই।
দ্বিতীয় দিন, ৬ আগস্ট। সেই রাতে অফিস ফেরার পথে আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলাম। বছিলার কাছাকাছি পৌঁছে দেখি কয়েকজন যুবক এক ব্যবসায়ীকে পথরোধ করে তাঁর টাকা এবং মোবাইল ছিনিয়ে নিচ্ছে। ব্যবসায়ী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে এক ছিনতাইকারী তাঁকে ছুরিকাঘাত করে।
প্রথম দিন রাতেই আমি অফিসে যাওয়ার পথে দেখি কিছু লোক একটি জুয়েলারি দোকানের তালা ভেঙে সবকিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা কেবল চেয়ে দেখছে, কিন্তু কিছু করার সাহস পাচ্ছে না। একসময় আমিও একপাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ চেয়ে দেখি। কোথাও কোনো পুলিশ নেই, যারা এসব থামাতে পারে।
দ্বিতীয় দিন, ৬ আগস্ট। সেই রাতে অফিস ফেরার পথে আমি বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলাম। বছিলার কাছাকাছি পৌঁছে দেখি কয়েকজন যুবক এক ব্যবসায়ীকে পথরোধ করে তাঁর টাকা এবং মোবাইল ছিনিয়ে নিচ্ছে। ব্যবসায়ী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে এক ছিনতাইকারী তাঁকে ছুরিকাঘাত করে। আমি আতঙ্কিত হয়ে এক গলিতে গিয়ে লুকিয়ে পড়ি। রাতের অন্ধকারে সেই রক্তাক্ত দৃশ্য আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে। কোথাও কোনো নিরাপত্তা বাহিনী নেই, কেউ নেই এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে।
তৃতীয় দিন, ৭ আগস্ট। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায়। আমি সেদিন অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতেই দেখি চারদিকে আতঙ্ক এবং অস্থিরতা। ডাকাতি হচ্ছিল বিভিন্ন বাসায়। এমন অবস্থায় কিছু মানুষ নিজেরাই দল গঠন করে পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তাঁদেরও সীমাবদ্ধতা ছিল।
এই তিন দিনের অভিজ্ঞতা আমাকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দেয়। যখন সরকার ছিল না এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল অদৃশ্য, তখন মানুষ যে কতটা অসহায় এবং নিরুপায় হয়ে পড়তে পারে, তা আমি নিজ চোখে দেখেছি।
পরবর্তীতে ৮ আগস্ট, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এসে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য তৎপর হন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়, তবে সেই তিন দিনের অভিজ্ঞতা মানুষ ভুলতে পারবে না। আমি এখনো রাতে কাজ করতে বের হলে সেই আতঙ্কিত মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।
সেই দিনগুলো আমাকে শিখিয়েছে যে যখন কোনো শাসনব্যবস্থা বা নিয়মকানুন থাকে না, তখন সমাজ কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। মানুষের বিশ্বাস, মানবিকতা সবকিছু যেন মুহূর্তে ধসে পড়ে। আজও সেই রাতগুলোর কথা মনে পড়লে আমার হৃদয়ে কাঁপন ধরে, চোখে ভেসে ওঠে লুটপাট আর নির্মম দৃশ্য।
উপসংহার:
শূন্যতার সেই তিন দিন আমাকে শুধু ভয়াবহ বাস্তবতা দেখায়নি, বরং জীবনের এক কঠিন শিক্ষা দিয়ে গেছে। যেখানে শাসন নেই, সেখানে মানবিকতাও হুমকির মুখে পড়ে।
মো. রফিকুল ইসলাম, ডেসপাচ কর্মকর্তা, উৎপাদন ও বিতরণ