উন্নয়নের লক্ষ্য হলো সব মানুষের জীবনের গুণগত মানের উন্নয়ন। জনসংখ্যার পরিমাণগত আকারের পাশাপাশি জনসংখ্যার গুণগত উন্নয়নও অত্যাবশ্যক—এই ঐকমত্য হয় মিসরের কায়রোয় অনুষ্ঠিত যুগান্তকারী জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (আইসিপিডি, ৫-১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪)। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১৭৯টি দেশের অংশগ্রহণে ওই সম্মেলন ছিল জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ভাবনায় এক ‘প্যারাডাইম’ শিফট বা চালচিত্র পরিবর্তন।
উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত হয় অধিকার ও পছন্দ। প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার, লিঙ্গসমতা, নারীর ক্ষমতায়ন, পরিবার পরিকল্পনার বিষয়গুলো জনসংখ্যা ও উন্নয়ন–সম্পর্কিত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি-পরিকল্পনায় যুক্ত হয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণমূলক ধারণা থেকে গুরুত্ব আসে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনায়।
আজ থেকে ৫২ বছর আগে বিশ্বে জনসংখ্যা নিয়ে যেসব ইস্যু ছিল, বর্তমানে তা ভিন্ন। অতীতে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি ও তরুণ জনসংখ্যার আধিক্য ছিল। বর্তমানে রয়েছে বাড়ন্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠী, স্থানান্তর বা অভিবাসনের বৃদ্ধি, বিদ্যমান ও বাড়ন্ত অসমতা, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, প্রযুক্তির বিকাশ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উচ্চমাত্রায় শিল্পায়ন।
এসব কিছু প্রভাব রাখছে অর্থনীতি, সমাজ, রাজনীতি ও পরিবেশের ওপর। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ অনুসরণ করছে। ফলে সবার জন্য টেকসই জনসংখ্যা ও উন্নয়ন জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনাই এখন মুখ্য।
এ ক্ষেত্রে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা হলো একটি চর্চা, যেখানে জনসংখ্যার আকারকে বজায়যোগ্য আকারে রাখতে হয়। যার অন্তর্ভুক্ত থাকবে জনসংখ্যার আকার, কাঠামো, বণ্টন, জনসংখ্যার বৃদ্ধি ইত্যাদি। ফলে জন্ম, মৃত্যু, স্থানান্তরের বিভিন্ন নির্দেশক বা প্রভাবকের ভিন্নতায় ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সম্পদের ব্যবহারে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
জনসংখ্যা কেবল সংখ্যা নয়, এটি বিদ্যমান জনসম্পদের সঠিক ও গুণগত ব্যবহারের দিককেও নির্দেশ করে। ফলে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা একটি দেশের উন্নয়নের মেরুদণ্ড, যেখানে জনসংখ্যার আকার ও বৃদ্ধি সম্পদের সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার মূল ক্ষেত্র হলো: জনসংখ্যা বৃদ্ধি ব্যবস্থাপনা, জনসংখ্যার বণ্টন ও গতিশীলতা এবং দায় থেকে সম্পদে রূপান্তর। জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হলেই শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অপরাধ ও দ্বন্দ্ব হ্রাস পাবে, সুশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে, টেকসই উন্নয়ন ঘটবে।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর বিশ্বের জনসংখ্যা পৌঁছে গেছে ৮০০ কোটিতে। এ জনসংখ্যার প্রায় ২ দশমিক ২ শতাংশ (১৭ কোটি ৩০ লাখ) মানুষ বসবাস করে পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল বাংলাদেশে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের ২০২২ পুনঃনিরীক্ষা প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ২০৩০ সালে হবে ১৮ কোটি ৪০ লাখ, ২০৪১ সালে ১৯ কোটি ৭০ লাখ আর ২০৫০ সালে ২০ কোটি ৪০ লাখ। আর জনসংখ্যার ঘনত্ব বর্তমানের ১ হাজার ৩২৯ জন (প্রতি বর্গকিলোমিটারে) ২০৫০ সালে পৌঁছে যাবে ১ হাজার ৫৬৬ জনে। সীমিত আয়তনের এ দেশে জনঘনত্ব বিশ্বে অন্যতম সর্বাধিক, যা ক্রমে বাড়বে।
সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা একটি বড় সংখ্যা, বড় সম্ভাবনা ও বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে এলেও জনসংখ্যার আকার ২০৫৭ সাল অবধি বাড়তে থাকবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ও পরিবার পরিকল্পনায় দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের রয়েছে তাৎপর্যময় সাফল্য।
জন্ম ও মৃত্যুহার কমে আসায় জনমিতিক রূপান্তর (ট্রান্সজিশন) ঘটছে—বর্তমানে আমরা তৃতীয় ধাপে রয়েছি। ফলে বয়সকাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে, যেখানে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বাধিক। ফলে জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সময় পার করছে বাংলাদেশ। এর মেয়াদ রয়েছে ২০৩৫-২০৩৬ পর্যন্ত। এ থেকে সর্বাধিক সুবিধা নিতে এ বিশাল জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।
কেননা, দ্রুত বয়স্ক জনগোষ্ঠীও বাড়ছে—২০৩০ সালের মধ্যে বয়স্ক এবং ২০৪৭ সালের মধ্যে বার্ধক্য সমাজে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ গ্রাম থেকে শহরমুখী স্থানান্তরের কারণে বা কোনো স্থানান্তর নীতিমালার অভাবে পরিকল্পিত নগরায়ণহীনতায় নগরের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ বলছে, ২০৪০ সালের আগেই বাংলাদেশের প্রতি দুজন মানুষের একজন বাস করবে নগরে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী, সুরক্ষাহীন জনগোষ্ঠী বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও চাহিদা নিশ্চিত করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
এখানে পরিবার বা গৃহস্থালির কাঠামো ও ধরনে পরিবর্তন আসছে। যৌথ বা বর্ধিত পরিবারের পরিবর্তে অণুপরিবারই এখন মুখ্য। সংক্রামক রোগের তুলনায় অসংক্রামক রোগই এখন মৃত্যুর মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সবকিছুর পরিবর্তন বা রূপান্তর অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্য সব ক্ষেত্রেই প্রভাব রাখছে।
জাতীয় পরিকল্পনায় জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা ও জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বের দাবি রাখলেও ২০১৬–পূর্ববর্তী কোনো জাতীয় নীতি-পরিকল্পনায় তা আসেনি, বিশেষ করে জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২–তে। তবে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক (২০১৬-২০২০) ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক (২০২০-২০২৫) পরিকল্পনায় ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০২১-২০৪১) জনমিতিক লভ্যাংশ ও জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি এলেও সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশলের (স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা) ঘাটতি রয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক ও প্রজননস্বাস্থ্য ও অধিকার উন্নয়নে রয়েছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
করোনা মহামারির আগে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হার হ্রাস, পাঁচ বছরের নিচে বয়সীদের ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যুর হার, মোট প্রজনন হার হ্রাস, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বৃদ্ধি ও আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেলেও এসব অগ্রগতির পাশাপাশি মহামারি–উত্তর নতুন ও উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ কিংবা অসম উন্নয়নও লক্ষণীয়।
জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক সম্মেলন আইসিপিডির ২৫ বছর পূর্তিতে প্রতিশ্রুত তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রা (শূন্য মাতৃমৃত্যু হার, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা এবং যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতন দূরীকরণ ও বাল্যবিবাহ) ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন বড় চ্যালেঞ্জ। এখনো বাল্যবিবাহ ও কিশোরী অবস্থায় গর্ভধারণের হার অনেক বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।
২০১১ ও পরবর্তী সময়ে পুরো প্রজনন হার হ্রাসে প্রতিস্থাপনযোগ্য হারে পৌঁছাতে পারেনি বা স্থিতাবস্থায় রয়েছে (বিডিএইচএস ২০২২)। জনসংখ্যা নীতি ২০১২-তে উল্লেখিত জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহারেরও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো যায়নি। ১৫-৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদার হারও এখনো বেশি, তবে ১৫-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে তা সর্বাধিক।
বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাল্যবিবাহ, কিশোরী মাতৃত্ব, শ্রমবাজারে নারীদের কম অংশগ্রহণ, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্থানীয় ও পরিবর্তিত বিশ্ববাজারে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি না হওয়া ও স্থানীয় শ্রমবাজারে উচ্চ যুব বেকারত্ব। শুধু বাল্যবিবাহের কারণেই অর্ধেকের বেশি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা হবে বাংলাদেশের জন্য দুরূহ।
ফলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে হলে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। দক্ষতাভিত্তিক পেশাগত জনশক্তি তৈরি করে রপ্তানি করতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সুযোগকে কাজে লাগাতে সর্বাধিক প্রচেষ্টা নিতে হবে।
বর্তমান ভবিষ্যৎ জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ ও জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হলে আমাদের দরকার জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুশিক্ষার বিস্তার, সুস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সুরক্ষাহীন জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়ন।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে অধিক বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার। উন্নয়ন কর্মসূচিতে বা জাতীয় নীতিতে আমাদের দরকার জনসংখ্যাকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে জনসংখ্যার গতিশীলতাকে অনুধাবন এবং সে অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে জনসংখ্যার ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।
মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক।