ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে প্রতিবাদের একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। মিছিলের সঙ্গে দুই দিন আমি গিয়েছিলাম শহীদ মিনারে। আমি দেখেছি, শিক্ষার্থীদের একটি আন্দোলন কীভাবে গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
সংবাদকর্মী হিসেবে প্রথম দিন মিছিলের সঙ্গে শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম ২ আগস্ট। দিনটি ছিল শুক্রবার। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সেদিন পবিত্র জুমার নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের কর্মসূচি ছিল। বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের কর্মসূচিও একই স্থানে। বামপন্থী–ডানপন্থীসহ একাধিক সংগঠন গণগ্রেপ্তার বন্ধ ও শিক্ষার্থী-জনতা হত্যার বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হয়। ওই দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সাংস্কৃতিক শিল্পীগোষ্ঠী উদীচীসহ অনেক সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশ করে।
২ আগস্ট আমার পেশাগত দায়িত্ব ছিল শাহবাগে। সেখানে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা অবস্থান নিয়েছিলেন। বিপুলসংখ্যক পুলিশ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) দিকে সাধারণ মানুষকে যেতে দেওয়া হচ্ছিল না। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আমরা কয়েকজন টিএসসির দিকে যাই। তখন টিএসসিতে দেখা হয় সহকর্মী কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনার সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মিছিলের সঙ্গে শহীদ মিনারে যাই। গিয়ে দেখি, হাজার হাজার মানুষ।
প্রেসক্লাবের সামনে দায়িত্ব ছিল আমার তখনকার সহকর্মী সামছুর রহমানের। তিনি জানিয়েছেন, নানা সংগঠনের কর্মসূচি ঘিরে বেলা দুইটার আগেই মানুষের ঢল নামে প্রেসক্লাব এলাকায়। লোকে লোকারণ্য প্রেসক্লাবের সামনে কোন সংগঠনের কী কর্মসূচি, তা পৃথক করার সুযোগ ছিল না। একপর্যায়ে পুরো প্রেসক্লাবের সামনের উপস্থিতি একক গণকর্মসূচিতে রূপ নেয়। মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় ২১টি সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে।
বিপুল মানুষের মধ্যে দেওয়া বক্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সরকারের পদত্যাগের দাবি তোলেন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শুরু হয় শিক্ষার্থী–জনতার দ্রোহযাত্রা। এটি কদম ফোয়ারা, হাইকোর্ট মোড়, দোয়েল চত্বর, টিএসসি ঘুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যায়।
২ আগস্ট ঢাকা ছিল প্রতিবাদমুখর। ওই দিন জুমার নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলটি শাহবাগ পর্যন্ত আসে। ওই দিন বিকেলে ‘চলমান পরিস্থিতিতে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার, জেসিও ও অন্যান্য সকল পদবির আহ্বান’ ব্যানারে ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে গণমিছিল ও সমাবেশ করেন রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএসে বসবাসকারী মানুষ। পরেও তাঁরা মিছিল করেছিলেন।
আগের দিন ১ আগস্ট কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যার প্রতিবাদে সকালে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’–এর ব্যানারে তাঁরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ইন্দিরা রোডের প্রান্তে সমবেত হন। সাধারণ শিল্পীদের অংশগ্রহণ আন্দোলনে নতুন মাত্রা দেয়। অভিভাবকসমাজও একাধিক কর্মসূচি পালন করেছিল।
তত দিনে অনেক ছাত্র–জনতার প্রাণ গেছে। চারদিকে ক্ষোভ–আতঙ্ক। খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাইরে বের হয় না। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেমে নেই। ৩ আগস্ট (শনিবার) বিকেলে আবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কর্মসূচি। সেদিন আমার দায়িত্ব পড়েছিল রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে। ওই দিন দুপুর ১২টায় অল্প কিছু শিক্ষার্থী রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে দাঁড়ালেন। তাঁদের হাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি ব্যানার। তাতে লেখা ‘সারা দেশে ছাত্র-নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে খুনের প্রতিবাদ ও ৯ দফা’ দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল। জমায়েত বড় হতে শুরু করে। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা রূপ নেয় বড় জমায়েতে।
বেলা আড়াইটার দিকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উদ্দেশে মিছিল নিয়ে রওনা হন। আমিও তাঁদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করি। নিউমার্কেট হয়ে মিছিল এগোতে থাকে। মিছিল দেখে মার্কেটের দোকানি–ক্রেতারা এসে ফুটপাতে দাঁড়ান। তাঁদের সবার চোখেমুখে যেন বিস্ময়—এত মানুষ! এতক্ষণ ধরে যাচ্ছে, তবু যেন নারী–পুরুষের সেই মিছিল শেষ হচ্ছিল না। আমারও অবাক লাগছিল এই ভেবে যে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে এত মানুষ ছিল!
দোকানকর্মী–ক্রেতা সবাই দাঁড়িয়ে থেকে মিছিলকারীদের অভিবাদন জানাচ্ছিলেন। আন্দোলনকারীরাও ফুটপাতে থাকা মানুষের মিছিলে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলেন।
মিছিলটি যখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রবেশ করে, সেখানে এত মানুষ ছিল যে মনে হলো সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে আসা মিছিলটি কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সাগরে নদীর মিশে যাওয়া যেমন হয়।
এর কিছুক্ষণ পর রাজধানীর ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর থেকে ব্যান্ড সংগীতশিল্পীদের নেতৃত্বে একটি মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসে। ব্যান্ড সংগীতশিল্পীদের মিছিল যে অংশ দিয়ে শহীদ মিনারে প্রবেশ করে, সেখানে রিকশাচালকেরা অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। তখন শহীদ মিনারের এমন অবস্থা যে জায়গাটি উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত—সব শ্রেণির মানুষের বিশাল এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। শহীদ মিনার থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, দোয়েল চত্বর, পলাশীসহ আশপাশের এলাকা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।
স্লোগানে প্রকম্পিত ছাত্র-জনতার জমায়েতের কেন্দ্র শহীদ মিনারে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে উপস্থিত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক। সবার দাবি জানতে চান তাঁরা। সবাই সমস্বরে এক দফা দাবির কথা জানান। ‘ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থান, অভ্যুত্থান’, ‘পদত্যাগ পদত্যাগ, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’ এমন স্লোগান ওঠে চারপাশে।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে এক দফার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এক দফা দাবির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। দফাটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এই সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপ।’ পরদিন রোববার থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণাও তুলে ধরেন তিনি।
শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি যেমন সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল; তেমনি পুরুষের পাশাপাশি ছিল বিপুলসংখ্যক নারীর উপস্থিতি। সব শ্রেণির মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিই যেন বলে দিচ্ছিল, সামনে কী হতে যাচ্ছে।
৫ আগস্ট আমরা দেখলাম, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো।
* প্রদীপ সরকার: নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো