মানুষ বিশ্বাস করে তথ্য দেন, সত্য তথ্য পেতেও চান

সাথী বেগমের সঙ্গে তাঁর দুই মেয়ে তামান্না ও মিতু
ছবি: সংগৃহীত

এ বছরের ২৬ জুলাইয়ের ঘটনা। সকালে অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন এল। অপর প্রান্তে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে এক নারী প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি প্রথম আলোর সাংবাদিক?’ আমার হ্যাঁ–সূচক উত্তরে তিনি নির্দ্বিধায় বললেন, ‘আমার দুইডা এতিম বাচ্চার জন্য কিছু কি করতে পারবাইন?’

কিছুই বুঝতে পারলাম না। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’ এবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। বললেন, ‘আমি তাজুলের  স্ত্রী।’ এটুকু বলার পরই আমি বুঝতে পারলাম, তিনি কাপাসিয়ার টোক ইউনিয়নের পাচুয়া গ্রামের তাজুল ইসলামের স্ত্রী। ২৪ জুলাই শ্রমিকবাহী বাসের সঙ্গে দ্রুতগামী ট্রেনের সংঘর্ষে এই তাজুল ইসলামের মৃত্যু ঘটেছে। তাজুল ছিলেন ওই বাসের চালক। এ ঘটনায় মারা গেছেন পাঁচজন। এ নিয়ে ঘটনার দিন ‘প্রথম আলো’ অনলাইনে খবর প্রকাশিত হয়।

তাজুলের স্ত্রীর এই আকুতি ছিল এতিম দুই শিশুকে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। জানতে পারলাম, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম তাজুল চলে যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে তাঁর স্ত্রী মারাত্মক অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। ওই নারী জানালেন, স্থানীয় এক ব্যক্তি অসহায় অবস্থার কথা জেনে তাঁকে আমার মুঠোফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন।

অসহায় এই নারীর কথা সবাইকে জানানোর তাগিদ অনুভব করলাম। প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দূরে তাজুলের গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে জেনে নিলাম ওই পরিবারের গল্প। সেদিনই প্রথম আলো অনলাইনে ‘আমার দুইডা এতিম বাচ্চার জন্য কিছু কি করতে পারবাইন’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। সংবাদটি দেখে পরদিন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মো. আনিসুর রহমান ওই পরিবারের খোঁজ নেন। শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামের মাধ্যমে নিহতের পরিবারের জন্য সরকারি বরাদ্দের ২০ হাজার টাকা দ্রুত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। একইভাবে নরসিংদী জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দুই এতিম শিশুর কয়েক মাসের খাবার, সেলাই মেশিন ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উপস্থিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক সেবা সংগঠন তাজুলের দুই সন্তানের জন্য ১৫ বছর ধরে পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচ বহনের দায়িত্ব নেয়।

গল্পটি শুধু একটি অসহায় পরিবারের দুরবস্থা থেকে মুক্তির কাহিনি নয়। প্রথম আলোর সাংবাদিক হিসেবে এটি আমার আত্মতৃপ্তিরও গল্প।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গাজীপুরের শ্রীপুরের উজিলাব গ্রামের জোনাকি আক্তারের কথা। এক পরিবারে ৮ জন্মান্ধের একজন সে। বয়স ১০ বছর। জন্মান্ধ হলেও পড়াশোনা করার তার প্রবল ইচ্ছা। এই ইচ্ছার কথা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়ার পর তার দৃষ্টি ফেরাতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় এক ব্যবসায়ী। পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও চিকিৎসা শেষে বছরখানেকের মধ্যেই জোনাকির প্রায় ৯০ শতাংশ দৃষ্টি ফিরে আসে। সেই জন্মান্ধ জোনাকি এখন একটি স্কুলে পড়াশোনা করছে। তার পরিবার পেয়েছে সরকারি বরাদ্দের ঘর। সংবাদ প্রকাশের পর জোনাকির দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার এই গল্পের সঙ্গে প্রথম আলো ও আমার নিজের গল্পটাও সমৃদ্ধ হয়েছে।

প্রাণী বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে একে একে নয়টি জেব্রার মৃত্যু হয়েছিল। এই তথ্য গোপন করা হয়েছিল। তবে খবরটি প্রথম আলোতে প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে সাড়া পড়ে যায়। এরপর অনুসন্ধান করে প্রথম আলোই জানতে পারে, শুধু জেব্রা নয়, মারা গেছে একটি বাঘও। পরবর্তীকালে তদন্ত কমিটির মাধ্যমে প্রাণী মৃত্যুর অবহেলার বিষয়টিও বেরিয়ে আসে। দায়ীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

২০১৬ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রথম আলোর সঙ্গে পথচলায় পেয়েছি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা। তৃণমূল পর্যায়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেখেছি, মানুষ আমাদের পত্রিকাটির ওপর ভরসা রাখেন। তাঁরা বিশ্বাস করে যেমন তথ্য দিতে চান, তেমনি সত্য তথ্য পেতেও চান। আর সে কারণেই প্রথম আলোর ওপর আস্থা রাখেন সবাই।

লেখক: প্রতিনিধি, শ্রীপুর, গাজীপুর