১৬ জুলাই। কোটা সংস্কারের দাবিতে সকাল থেকে রংপুরে আন্দোলন চলছিল। বিকেল চারটার দিকে জানতে পারলাম, পুলিশের গুলিতে একজন মারা গেছেন। লাশ আছে রংপুর মেডিকেলে। আমার অবস্থান তখন রংপুর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে, বদরগঞ্জে। অফিস থেকে বলা হলো, ‘আপনি দ্রুত রংপুরে যান, তবে সাবধানে।’ সঙ্গে নিহত ছাত্রের পরিচয়–ঠিকানাসহ বিস্তারিত পাঠাল অফিস। জানা গেল, নিহত ছাত্রের নাম আবু সাঈদ। বাড়ি পীরগঞ্জের মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামে। পড়তেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
বদরগঞ্জ থেকে রংপুরে পৌঁছাই বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে। তখন অফিস থেকে নির্দেশনা, দ্রুত শহীদ আবু সাঈদের গ্রামের বাড়িতে যান। আবার ল্যাপটপ কাঁধে মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলাম আবু সাঈদের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে।
পীরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে বাবনপুরের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। প্রায় ৯ কিলোমিটার যাওয়ার পর জাফরপাড়া বাজার। সেখানে পৌঁছে দেখি দোকানপাট বন্ধ। সুনসান নীরবতা। ওই বাজার থেকেই বাবনপুরে যাওয়ার সড়কে বাঁক নিতে দু–চারজন মানুষ যা চোখে পড়ল, তাঁদের মধ্যে অজানা এক ভীতি। জাফরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে যাওয়ার পর একজন রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। তখন বিদ্যুৎ ছিল না।
অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল আন্দোলনের অগ্রনায়ক আবু সাঈদের বাড়ি। তখন সন্ধ্যা সোয়া সাতটা। বাড়ির ভেতরে স্বজনদের আহাজারি বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছিল। মোটরসাইকেল রেখে সরু গলি ধরে মুঠোফোনের টর্চ জ্বালিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকি। উঠানে কয়েকজন চেয়ারে বসে আছেন। বারান্দায় এক তরুণী বুক চাপড়ে কাঁদছেন। পাশে এক বৃদ্ধা আহাজারি করছেন, ‘মোর সোনার বাবাটাক পুলিশ গুলি করিয়া মারল ক্যান। ও তো কাউকে মারতে যায় নাই। চাকরি চাওয়াটা কি অপরাধ? অই পুলিশ, তুই মোকে গুলি করিয়া মারলু না ক্যান?’
তরুণীটি বলছিলেন, ‘ও ভাই, তুই হামাক ভাসে থুইয়া কোনটে হারে গেলু। তুই তো কচলু, বইন, মুই চাকরি করলে অভাব থাইকপের নেয়। নেজে কামাই করিয়া কত কষ্ট করি পড়লু। তার ফল কি এইটা?’
বুঝতে বাকি থাকল না ক্রন্দনরত বৃদ্ধা আবু সাঈদের মা আর তরুণী তাঁর বোন।
সংবাদকর্মী হিসেবে মানুষের মৃত্যুর ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে বহুবার। কিন্তু সেদিন আবু সাঈদের মা ও বোনের আহাজারি দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলাম না! এমন শোকাতুর পরিবেশে কারও সঙ্গে কথাও কঠিন। পরে এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে জানা গেল, সাঈদের মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম, বোন সুমি বেগম।
রাতভর সাঈদের বাড়ির ভেতর–বাইরে পায়চারি করতে থাকি। অজানা ভয়ে জড়সড় প্রতিবেশীদের অনেকে ওই রাতে সাঈদদের বাড়িতে আসেননি।
আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী লাশ আনতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেছেন। অন্য ভাইয়েরা কেউ বাড়িতে ছিলেন না।
আবু সাঈদের লাশের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর মা–বোনসহ অন্যরা। কিন্তু লাশ কখন আসবে, তা কেউ বলতে পারছিলেন না। রাত সাড়ে নয়টার দিকে সাদা পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তি তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়িতে আসেন। পরিচয় জানালেন, তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ। অন্যজন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল আমিন। বাকি দুজন তাঁর সহযোগী। তাঁরা বাড়ির উঠানে কিছুক্ষণ কী সলাপরামর্শ করে চলে গেলেন।
দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে কেউ একজন বললেন, লাশ নিয়ে রমজান আলী রংপুর থেকে রওনা হয়েছেন। ফোন করে আমিও নিশ্চিত হই বিষয়টি। এর পরপরই সেখানে ছড়িয়ে পড়ে প্রশাসনের নির্দেশনা—রাতেই লাশ দাফন করতে হবে। রাত দুইটার দিকে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স এসে বাড়ির পাশে থামল। লোকজন অ্যাম্বুলেন্সের কাছে ছুটে গেলেন। লাশ নামিয়ে উঠানে রাখা হলো। এর পরের দৃশ্য বর্ণনাতীত! স্বজনহারা মানুষের সে–কী আহাজারি!
লাশের সঙ্গে এসেছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাঁরা আবু সাঈদের স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় বাড়ির অদূরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল।
গভীর রাতে তাৎক্ষণিকভাবে লাশ দাফনের তোড়জোড় শুরু করেন অজ্ঞাত কয়েকজন ব্যক্তি। তখন আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী ও শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ রুখে দাঁড়ালে সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অজ্ঞাত লোকজনও সটকে পড়েন। পরে স্বজনেরা সিদ্ধান্ত নেন, সকাল নয়টায় স্থানীয় জাফরপাড়া কামিল মাদ্রাসা মাঠে আবু সাঈদের জানাজা পড়ানো হবে।
রাত সাড়ে তিনটার দিকে খাবারের খোঁজে পাশের জাফরপাড়া বাজারে যাই। সেখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে তখন ১৫ থেকে ১৬টি গাড়িতে সতর্ক পাহারায় দেখা গেল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। আবার আবু সাঈদের বাড়িতে ফিরে আসি।
সূর্যের আলো ফোটার পর থেকে ওই বাড়িতে ভিড় বাড়তে থাকে। সোয়া আটটার দিকে জানাজার জন্য লাশ জাফরপাড়া কামিল মাদ্রাসার মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকধারী কেউ না থাকলেও পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইকবাল হাসান উপস্থিত ছিলেন। তিনি দ্রুত জানাজা পড়ানোর তাগিদ দেন। উপস্থিত কয়েক শিক্ষার্থী তাঁকে ১৫ মিনিট দেরি করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আবু সাঈদের কয়েকজন সহপাঠী ও শিক্ষক আসছেন। কিন্তু ইউএনও তা নাকচ করে দিলে কিছুটা উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর মধ্যেই ইউএনও একজনকে সামনে দাঁড় করিয়ে জানাজার নামাজ পড়ানো শুরু করেন। তখন জানাজার সারিতে দাঁড়ানো অনেকেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন; তাঁরা নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকেন। অবস্থা বেগতিক দেখে জানাজা শেষ করে দ্রুত মাঠ ছেড়ে যান ইউএনও।
পরে আবু সাঈদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক ও কয়েক শিক্ষার্থী আসার পর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে দ্বিতীয় দফায় জানাজা পড়ানো হয়। বাড়ির পাশে দাফন করা হয় আবু সাঈদকে। দাফনের পরও আবু সাঈদের বাড়িতে মানুষ আসছিল। স্বজনদের কান্না থামছিল না।
বেলা ১১টার দিকে যখন আবু সাঈদের গ্রাম ত্যাগ করি, তখন সূর্যটাকে মেঘ খানিকটা আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু সূর্য একসময় ঠিকই সব আড়াল ভেদ করে আলো ছড়ায় চারদিকে। আবু সাঈদও যে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ হয়ে উঠবেন, জায়গা করে নেবেন ইতিহাসের পাতায়, সেই বার্তাও যেন অলক্ষ্যে কোথাও স্পষ্ট হচ্ছিল…।
প্রতিনিধি, বদরগঞ্জ, রংপুর, প্রথম আলো