আন্দোলনের কথা মনে করতে গেলেই চোখে ভাসছে পুলিশের নির্বিচার গুলি, হাসপাতালে আহত মানুষের ঢল, বাসিন্দাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তার গল্প। তাই কোনটা রেখে কোনটা লিখব বা কোনটা লিখলে কোনটা বাদ পড়ছে, তা-ই ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না।
আন্দোলনের খবর সংগ্রহে আমি ছিলাম রাজধানীর উত্তরায়। ঢাকার যে কটি জায়গায় বড় বা সংঘাতময় আন্দোলন হয়েছে, তার একটি উত্তরা। এখানে কাজ করতে গিয়ে কখনো বিচলিত হয়েছি, কখনো ঝুঁকির মধ্যে পড়েছি, কখনোবা ভেঙে পড়েছি মানসিকভাবে। তারপরও মাঠে ছিলাম আন্দোলনের পুরোটা সময়।
১৮ জুলাই সন্ধ্যা ছয়টা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পিছু হটেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য। কিছু পুলিশ সদস্য উত্তরা পূর্ব থানা পাহারায় অবস্থান নেন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। ততক্ষণে পুলিশের গুলিতে আহত ও নিহত শিক্ষার্থীর খবর ছড়িয়েছে। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন আশপাশের এলাকার হাজারো মানুষ। তাঁরা থানা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করছেন। পুলিশ ছুড়ছে মুহুর্মুহু গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল।
আমি তখন ঠিক বিএনএস সেন্টারের সামনে। পুলিশের নির্বিচার ছোড়া গুলিগুলো পাতলা শব্দ হয়ে ভেসে যাচ্ছে কানের পাশ দিয়ে, মনে হচ্ছে এই বুঝি লেগে গেল। বাতাসে কাঁদানে গ্যাসের তীব্র ঝাঁজ। সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা। আমি এর মধ্যেই ছবি তোলার জন্য এগিয়ে যাই ঘটনাস্থলের দিকে।
আশ্রয় নিই আজমপুর পদচারী–সেতুর পূর্ব পাশের সিঁড়ির নিচে। পদচারী–সেতু আর পূর্ব থানার দূরত্ব আনুমানিক ১৫০ মিটার। পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্যেই হঠাৎ চোখ আটকে যায় শাহজালাল অ্যাভিনিউ সড়কের মাথায়। সেখানে পড়ে আছেন গুলিবিদ্ধ এক যুবক। ‘ভাই, আমারে বাঁচান’ বলে চিৎকার করছেন। কিন্তু পুলিশের গুলির মুখে কেউ এগোতে পারছেন না। পরে জেনেছিলাম, তাঁকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে সেই স্মৃতি। এখনো কানে বাজে ওই যুবকের ‘ভাই, আমারে বাঁচান’ আকুতিটি।
১৮ জুলাই। বেলা একটার দিকে আহত বা নিহতের খবর নিতে আমি যাই উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখনো পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। মূল ফটক পেরিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রবেশ করতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। একের পর এক আহত রোগী আসছেন। তাঁদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ (প্যালেট)। নার্সরা দ্রুত তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। জরুরি বিভাগের ধারণক্ষমতা শেষ। অনেকে পড়ে আছেন হাসপাতালের মেঝে, বারান্দা ও সামনের ফাঁকা জায়গায়। একই চিত্র ছিল উত্তরা ক্রিসেন্ট ও বাংলাদেশ-কুয়েত হাসপাতালে।
১৯ জুলাই, শুক্রবার। জুমার নামাজের পর আবারও শুরু হয় সংঘর্ষ। এর মধ্যেই বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে খবর আসে হাউস বিল্ডিং এলাকায় সংঘর্ষে আহত হয়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। আমি ছুটলাম ঘটনাস্থলের দিকে।
বিক্ষোভ তখন ছড়িয়ে পড়েছে উত্তরার অলিগলিতে। নানা ঝক্কি পেরিয়ে বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে পৌঁছাই উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে। দেখি, সেখানে একটি বটগাছের নিচে পড়ে আছে এক ব্যক্তির লাশ। বলাবলি হচ্ছিল, নিহত ব্যক্তি জাহাঙ্গীরের পিএস (একান্ত সচিব)। একটি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে একটি ছবি তুলেছি। এর মধ্যেই পেছন থেকে লাঠি হাতে কয়েকজন তরুণ আমাকে ঘিরে ধরেন। কোনো কথা না বলেই শুরু করেন কিলঘুষি। একপর্যায়ে একজন রড হাতে এগিয়ে আসে আমার দিকে। আমাকে মাথায় বাড়ি দেবে, ঠিক এমন সময় হঠাৎ সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় সবাই। আমিও দৌড়ে প্রাণ বাঁচাই।
* আল-আমিন: প্রতিনিধি, গাজীপুর, প্রথম আলো