দুটি শব্দ মনে আসছে। ‘নিরলসভাবে’ ও ‘বিস্তৃত পরিসরে’। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘রিলেন্টলেসলি’ ও ‘এক্সটেনসিভলি’। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে মানুষের মৃত্যুর হিসাব রাখতে প্রথম আলোর যে প্রচেষ্টা, তাকে এই দুটি শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
জুলাই–আগস্টে মানুষের মৃত্যুর খবরগুলো প্রথম আলো রেখেছে। সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে অনলাইন সংস্করণে প্রকাশ করেছে প্রথম আলো এবং পত্রিকায় খবরগুলো প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রথম আলো ভুল করেনি।
শুধু নিহতের তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ নয়; কারা মারা গেছেন, তাঁদের বয়স কত, পেশা কী, কত শিশু মারা গেছে, কত নারী মারা গেছেন, কত মানুষ বাসায় থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন—এসব তথ্য পাওয়া গেছে প্রথম আলোয়। কত মানুষের মরদেহে গুলির চিহ্ন ছিল, কয়জন একটি গুলিতে, কয়জন একাধিক গুলিতে, কয়জন প্রাণঘাতী গুলিতে, কয়জন ছররা গুলিতে বিদ্ধ হয়েছিলেন, সেই তথ্য প্রথম আলো জুলাই ও আগস্ট মাসে বিশ্লেষণ করেছে এবং প্রকাশ করেছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৬ জুলাই প্রথম মৃত্যুর (৬ জন) ঘটনা ঘটে। সেদিন রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ জুলাই ঢাকা আক্ষরিক অর্থেই রণক্ষেত্র। সংঘর্ষ হয়েছে অনেক জেলায়। নির্বিচার গুলিতে মৃত্যুর খবর আসছে। প্রথম আলোর নীতি ছিল, আমরা প্রতিটি মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করব, অনুসন্ধান করব এবং তা প্রকাশ করব। একই সঙ্গে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতি মেনে চলব। মানে হলো, নিজেরা নিশ্চিত না হয়ে একটি মৃত্যুর খবরও দেব না।
মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহের জন্য মোটাদাগে তিনটি সূত্রের ওপর আমরা নির্ভর করেছিলাম—১. হাসপাতালের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সেখানে মরদেহ নিয়ে আসা মানুষেরা। ২. নিহতদের স্বজন এবং ৩. পুলিশ যদি কোনো মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে।
আন্দোলন, বিক্ষোভ, হামলা এবং সহিংসতার দিনগুলোয় মরদেহ ও গুরুতর আহত ব্যক্তিদের বেশি নিয়ে আসা হচ্ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে আমাদের প্রতিবেদক ও সংবাদদাতা পালা করে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সশরীর থাকতেন। নিহতদের নিয়ে আসা ব্যক্তি, যানবাহনের চালক ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতেন। ৮ আগস্ট পর্যন্ত আমরা এভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছি। পরে হাসপাতালে কারও মৃত্যু হলে অথবা অন্য কোথাও মৃত্যুর খবর পেলে সেই তথ্য সংগ্রহ করে আমাদের তালিকা হালনাগাদ করেছি। ঢাকায় আমাদের অন্তত ১৩ জন প্রতিবেদক বিক্ষোভস্থল, হাসপাতাল, স্বজন ও পুলিশের কাছ থেকে নিহত ও আহত মানুষের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছেন। আমাদের প্রতিবেদকদের একটি দল এক সপ্তাহ ধরে ঢাকার ৩৭টি হাসপাতালে ঘুরেছে। জেলা শহরের হাসপাতাল, পুলিশ ও স্বজনদের কাছ থেকে মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করেছেন অন্তত ১৩২ জন প্রতিবেদক ও প্রতিনিধি। মাঠ থেকে ছবি তুলেছেন, ভিডিও করেছেন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে দায়িত্ব পালন করা আমাদের আলোকচিত্রী ও ভিডিওগ্রাফাররা।
কাজটি সহজ ছিল না। রক্ত, আর্তনাদ, আহাজারির মধ্যে আমাদের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাসপাতালে অপেক্ষা করেছেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তির একটি বক্তব্য পাওয়ার জন্য অবহেলা, অনেক ক্ষেত্রে অপমানও সহ্য করেছেন।
হাসপাতালগুলো সরকারি চাপে মৃত্যুর তথ্য গোপনের চেষ্টা করত। প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা সেগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করতেন। যখন কেউ স্বীকার করত না, তখন ভরসা ছিল হাসপাতালের মৃত্যুনিবন্ধন খাতা।
২৫ জুলাই প্রথম আলোয় নিহতের সংখ্যা ২০০ ছাড়ানোর খবর দেওয়া হয় (১৬ জুলাই থেকে)। তখন পর্যন্ত সরকার কোনো মৃত্যুসংখ্যা জানায়নি। আগের দিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কূটনীতিকদের বলেন, হতাহতের সংখ্যা নিরূপণে সরকার কাজ করছে।
নিহতের সংখ্যা প্রকাশ থেকে বিরত রাখার জন্য সরকারের চাপ ছিল। গোয়েন্দা সংস্থার ফোন আসত। ফলে বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম নিয়মিত হিসাবটি প্রচার করত না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যাটি লেখা হলেও তা থাকত প্রতিবেদনের ভেতরে অথবা ভেতরের পাতায়। প্রথম আলো নিয়মিতভাবে প্রথম পাতায় মৃত্যুর সংখ্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে যখন হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে একটি বয়ান বা ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছিল। সেটি হলো, আন্দোলনকারীরা মূলত বিএনপি ও জামায়াতের নেতা–কর্মী। প্রথম আলো মানুষের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখায়, সরকারের বয়ান আসলে সঠিক নয়।
২৯ জুলাই প্রথম আলোয় ১৫০ জনের মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রকাশিত হয় ‘নিহত ১১৩ জন কম বয়সী, শিক্ষার্থী ৪৫’ শিরোনামের প্রতিবেদন। আমরা থেমে থাকিনি। ২ আগস্ট ১৭৫ জন নিহতের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রকাশিত হয়, ‘নিহত ৭৮ শতাংশের শরীরে প্রাণঘাতী গুলির ক্ষত’। এই প্রতিবেদনেই উঠে আসে, প্রাণঘাতী গুলির কী ভয়ানক ব্যবহার হয়েছে। ১৪ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘বাসাও নিরাপদ নয়, গুলিতে মৃত্যু ছয় নারী ও মেয়েশিশুর’। ১৭ আগস্ট আমরা প্রকাশ করি শিশুমৃত্যুর হিসাব। তখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘নিহতদের মধ্যে ৬৬ শিশু–কিশোর’। শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যার প্রতিবেদন পরে হালনাগাদ করা হয়।
প্রাণঘাতী গুলির ব্যবহার নিয়ে ২৮ আগস্ট প্রকাশিত হয় ‘আইন লঙ্ঘন করে নির্বিচার প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার’।
নিহত ব্যক্তিরা সন্ত্রাসীদের গুলিতে মারা গেছেন, আদালতে সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের পুলিশ। সেটা প্রথম ফাঁস করে প্রথম আলো। ১ আগস্ট প্রকাশিত হয় ‘মানুষের মৃত্যু সন্ত্রাসীদের গুলিতে, বলছে পুলিশ’ শিরোনামের প্রতিবেদন। মামলার এজাহার বিশ্লেষণভিত্তিক প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয় যে পুলিশের মামলায় গুলির জন্য সন্ত্রাসীদের দায়ী করা হচ্ছে। আন্দোলনের মুখে গণহারে গ্রেপ্তার নিয়ে ৩১ জুলাই প্রকাশিত হয় ‘ঢাকায় গ্রেপ্তার ৮৭ শতাংশের রাজনৈতিক পরিচয় নেই’।
এর বাইরে নিহতদের নিয়ে, তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন করেছেন প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা। ১১ বছরের শিশু সাফকাত সামিরকে নিয়ে লেখা ‘জানালায় দাঁড়াতেই গুলি এসে কেড়ে নিল শিশুটিকে’, সাড়ে ছয় বছরের রিয়া গোপকে নিয়ে লেখা ‘বাসার ছাদে বাবার কোলে ঢলে পড়ে ছোট্ট মেয়েটি’, সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাহমুদুর রহমানকে (সৈকত) নিয়ে লেখা ‘একজন ফোন ধরে বলল, আপনার ছেলে মরে গেছে’, নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডে গুলিতে নিহত কিশোর মো. রাসেলকে (১৫) নিয়ে লেখা ‘কতই না আর্তনাদ করিছে ছেলে’, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফারহান ফাইয়াজকে নিয়ে লেখা, ‘এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে’, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী মীর মাহফুজুর রহমানকে (মুগ্ধ) নিয়ে লেখা ‘মুগ্ধদের আন্দোলন তো এখনো শেষ হয়নি’—আরও অনেক প্রতিবেদন ধারাবাহিকভাবে প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে।
একটা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকার মানবিক প্রতিবেদন প্রকাশ না করার জন্য চাপ দিয়েছিল। প্রথম আলো সেই চাপ উপেক্ষা করে নিহতদের কথা, স্বজন হারানো পরিবারগুলোর কথা তুলে ধরেছে।
শুধু মৃত্যু নয়, যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা মানুষদের নিয়ে হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। ঢাকার ৩১টি হাসপাতাল ঘুরে ২৯ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয় আহতের সংখ্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন। শিরোনাম ছিল, ‘আহত ৬ হাজার ৭০৩ জন’। পরে আরও আহতের তথ্য পাওয়া গেছে।
আহতদের নিয়ে ‘পেটে গুলি, বুকে গুলি, পায়ে গুলি, কাতরাচ্ছেন তাঁরা’, ‘গুলিতে চোখ নষ্ট ৪০১ জনের’, ‘সংঘাতে চোখে গুলি: নতুন বাংলাদেশ নিজের চোখে দেখা হলো না’, ‘হাত–পা হারালেন ১৯ জন’—এমন অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোর অনলাইন ও ছাপা পত্রিকায়।
সময়ে সময়ে প্রথম আলো নিহত ও আহতের সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সময়ে সময়ে তা হালনাগাদ হয়েছে। প্রথম আলো এখন পর্যন্ত নিহত ৭৬৬ জনের তথ্য পেয়েছে। সরকার এখন পূর্ণাঙ্গ তালিকা করছে। খসড়া তালিকায় নিহতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে ৮৭২ জন (৩০ অক্টোবর, ২০২৪)।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ছাড়া বিক্ষোভে করা গুলিতে এত মৃত্যু মানুষ দেখেনি। মাঠে থাকা প্রথম আলোর তরুণ প্রতিবেদকেরাও নিজ দেশের মানুষের ওপর এত গুলি চালাতে দেখেননি। রক্ত, লাশ, আহাজারি, স্বজনদের কান্না দেখে তাঁরাও ‘ট্রমায়’ (মানসিক আঘাত) আক্রান্ত হয়েছিলেন। বিক্ষোভের মধ্যে পড়ে কেউ কেউ হামলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু দায়িত্ব থেকে পিছু হটেননি।
সারা দেশে যখন কারফিউ, প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ নারী সহকর্মীদের বাসা থেকে কাজ করা অথবা ছুটি নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি, নারী সহকর্মীরা ছুটি না নিয়ে কাজ করতে আগ্রহ দেখিয়েছেন, কাজ করেছেন।
প্রথম আলোর সব বিভাগ ছিল সক্রিয় ও উদ্যোগী। বার্তাকক্ষ থেকে অনলাইনে দ্রুত পাঠককে খবর দেওয়ার চেষ্টা ছিল। সংবাদ ব্যবস্থাপকেরা সকালে, দুপুরে, বিকেলে, রাতে দফায় দফায় প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করেছেন। পাঠকের সাড়াও ছিল অসাধারণ। যেমন আগস্ট মাসে প্রথম আলোর অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ পাঠ করা হয়েছে ৩৫ কোটি বার (পেজভিউ)। প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার পাঠকও বেড়েছে।
প্রথম আলো ৪ নভেম্বর ২৭তম বছরে পা দিয়েছে। বিগত ২৬ বছরের মধ্যে প্রথম আলো সবচেয়ে চাপে ছিল সাম্প্রতিককালে। সবচেয়ে বেশি চাপের মধ্যে প্রথম আলো সেরা সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেছে ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। নতুন পরিস্থিতিতে প্রথম আলোর ওপর নানামুখী চাপ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। কোনো চাপের কাছেই প্রথম আলো নত হবে না। বাংলাদেশের স্বার্থে, বাংলাদেশের বিজয়ের জন্য সাহসী সাংবাদিকতা চলবে।
ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, অনলাইন, প্রথম আলো