প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।
প্রথম আলো যাত্রা শুরুর দিন থেকেই নিয়মিত সঙ্গী হয়ে যায়। আর যা–ই হোক, ঘুম থেকে উঠে এই পত্রিকা লাগবেই। কিন্তু হঠাৎ একদিন দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে। কারণ, হকার বলে গেছে, আর পত্রিকা দেবে না। হকারের মুখে এমন কথা শুনে আতঙ্কিত হন ৭৮ বছরের গুণী অভিনেত্রী দিলারা জামান। তিনি হকারকে ডেকে দূর থেকে মুখে মাস্ক পরে অনুরোধ করেন পত্রিকা দিতে। কিন্তু হকারের এক কথা, আশপাশে সবাই পত্রিকা নেওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছে। তাঁর এই ভবনে আসা অনেক কষ্টের। সব শুনে দিলারা জামান একই অনুরোধ পুনরাবৃত্তি করে বলতেন, ‘আমার পত্রিকা দেওয়া বন্ধ কোরো না, অনুরোধ করছি, বাবা। সকালে প্রথম আলো না পড়লে মনে হয় কিছু একটা নাই। এই বয়সে আরও দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই।’ তার পর থেকে মুখ কালো করে প্রথম আলো দিয়ে যেত হকার।
বিশ্বজুড়ে ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হয়। করোনাকালে প্রায়ই কথা হতো গুণী প্রবীণ এই অভিনেত্রীর সঙ্গে। শোনাতেন করোনার দিনকাল, একাকিত্ব আর শৈশবে দিনগুলোর কথা। তিনি ফিরে যেতে চাইতেন শৈশবে। তাঁকে প্রশ্ন করতাম, শৈশবের দিন ফিরে পেলে কী করবেন? তিনি উত্তর দিতে দেরি করেন না, ঝটফট করে বলেন, ‘শৈশব ফিরে পেলে ঝড়ের দিনে বাড়ির পাশের গাছ থেকে আম কুড়াতে যেতাম। বৃষ্টিতে ভিজতাম।’
তবে আলাপের মধ্যে ঘুরেফিরে আসত অদৃশ্য শক্র করোনার কথা। একা থাকতেন বলে চিন্তা করতেন বেশি। তবে দুই মেয়ে দেশের বাইরে থাকলেও সব সময় খরর নিতেন। সেই দিনগুলোয় কথায় কথায় ঘুরেফিরে আসত প্রথম আলোর করোনার নিয়ে নানা প্রতিবেদনের কথা; আর শোনাতেন পত্রিকা কীভাবে সংগ্রহ করতেন, সেই গল্প। এখানেও নানা নাটকীয়তা। যার মূলে প্রাধান্য পেত ৭৮ বছরের এক অভিনেত্রীর বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প।
দুই মেয়ে দেশের বাইরে থেকে প্রায়ই কড়া ভাষায় নাকি বলতেন, কোনোভাবেই আর শুটিং করা যাবে না। করোনা পরিস্থিতির জন্য দীর্ঘ সময় শুটিং থেকে একেবারেই দূরে সরে যান। সেই সময়ে গুজব ছড়ায় যে পত্রিকার মাধ্যমেও করোনা ছড়ায়। মেয়েরা পত্রিকা রাখতে ‘না’ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েদের না জানিয়েই পত্রিকা রাখতেন দিলারা জামান। তাঁকে মাঝেমধ্যে বলতাম, ‘পত্রিকা রাখা ছেড়ে দেন।’ তিনি হেসে একই কথা বলতেন, ‘আমাদের মৃত্যু কি কেউ আটকাতে পারবে। একদিন তো মরতেই হবে। এত ভয় পাই না আমি। পত্রিকা পড়ে কেউ মরলে কি প্রথম আলো বের হতো।’
শোনাতেন কীভাবে প্রথম আলো সংগ্রহ করতেন, সেই গল্প। এ জন্য তিন থেকে চার স্তরের নিরাপত্তা ছিল। প্রথমে পত্রিকার হকার কলিং বেল দিয়ে পত্রিকাটি রেখে যেতেন। সেটা অনেকটা সময় দরজার পাশেই রেখে দিতেন। কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট পরে পত্রিকায় সেনিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতেন। হাতে গ্লাভস ও মুখে মাস্ক নিয়ে পত্রিকা ভয়ে ভয়ে ধরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসতেন। পরে পত্রিকাটি নিরাপদ স্থানে রেখে আয়রন করে নিতেন। তারপরে নিরাপত্তা নিয়ে পত্রিকাটি পড়তেন।
সম্প্রতি কথা হলে দিলারা জামান সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘পত্রিকা পড়া হলে কতবার যে সাবান দিয়ে হাত ধুতাম, আবার সেনিটাইজার নিতাম। যেখানে পত্রিকা রাখতাম, সেখানে সেনিটাইজ করতাম বারবার। কী আতঙ্কে দিন কাটত! একবার করোনা হলেই জীবনটা শেষ।’
তখন লিফটে উঠতে ভয়, বাইরে যেতে ভয়, সারাক্ষণ রুমেই থাকতে হতো। হাঁটতেও যেতে পারতাম না। পত্রিকায় দেশের নানা খবর পেতাম। কী হচ্ছে, সব খুঁটিয়ে জানতাম। একটু দেরি হলেই মনে হতো, আজ মনে হয় পত্রিকা আর দেবে না।দিলারা জামান
সেই সময়ে পত্রিকার পড়ার পরে দিলারা জামানের সবচেয়ে বেশি সময় কাটত আরেক অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলে। দুই বছর আগে তিনি মারা যান। তাঁকে পত্রিকা রাখার কথা শোনালে চমকে উঠতেন। ‘শর্মিলী বলত, “বুবু, তুমি পত্রিকা পড়া ছেড়ে দাও। এই বয়সে মরণ ডেকে এনো না।” শুধু শর্মিলী নয়, যাঁরাই সেই সময় পত্রিকা পড়ার কথা শুনতেন, সবাই চমকে উঠতেন। আমার এমনিতেই বয়স ৮০ কাছাকাছি। বুড়োবুড়িরা মরে যাচ্ছে। আমাকে নিয়ে আতঙ্ক ছিল বেশি। সহকর্মীরা যে আমাকে কত ভালোবাসে, তখন বুঝেছি,’ বলেন দিলারা জামান।
এর মধ্যেই একদিন মন খারাপ করে জানালেন, পত্রিকা পড়া মনে হয় আর হবে না। তখন করোনার প্রকোপ আরও বেড়েছে। করোনাভাইরাসে বিশ্বে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছিল। দিলার জামানের সেই ঘটনা এখনো মনে আছে।
স্বামী বেঁচে থাকতে ৫টি পত্রিকা রাখতেন। এখন খরচ কুলিয়ে উঠতে পারেন না। যে কারণে প্রথম আলোসহ আরেকটা পত্রিকা রাখার অভ্যাস রয়ে গেছে।
গত ২৮ অক্টোবর রাতে সেই দিনগুলো নিয়ে হঠাৎ কথা হয় এই গুণী অভিনেত্রীর সঙ্গে। দিলারা জামান বলেন, ‘তখন লিফটে উঠতে ভয়, বাইরে যেতে ভয়, সারাক্ষণ রুমেই থাকতে হতো। হাঁটতেও যেতে পারতাম না। পত্রিকায় দেশের নানা খবর পেতাম। কী হচ্ছে, সব খুঁটিয়ে জানতাম। একটু দেরি হলেই মনে হতো, আজ মনে হয় পত্রিকা আর দেবে না। এর মধ্যেই একদিন তো হকার রাগ করে বলেই দিল, এদিকে পত্রিকা দেবেই না। আমার বাসা উত্তরা। তখন নাকি পুরো উত্তরাতেই অল্পসংখ্যক পত্রিকা আসত। আশপাশের সবাই ভয়ে পত্রিকা ‘না’ করে দিয়েছে। শুধু আমার জন্যই তাকে অনেক দূরে আসতে হয়। এবার সে বেঁকে বসল, আর আসবেই না। অনেক অনুনয়-বিনয় করেই হকারের মন গলাতে হতো। কিন্তু প্রতিদিনই বুঝতাম তার মুখ কালো। পত্রিকার জন্য হকারের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে গেল। সেই দিন থেকে মুখ কালো করে প্রথম আলো দিয়ে যেত হকার।’
দিলারা জামান জানান, তাঁর স্বামী বেঁচে থাকতে ৫টি পত্রিকা রাখতেন। এখন খরচ কুলিয়ে উঠতে পারেন না। যে কারণে প্রথম আলোসহ আরেকটা পত্রিকা রাখার অভ্যাস রয়ে গেছে। সবশেষে বলেন, ‘তারপরও বেঁচে আছি। জীবনের ৮১ বছর পেরিয়ে গেল। এখনো সকালে প্রথম আলো আসতে দেরি হলে খালি খালি লাগে। প্রথম আলো পড়া আমার কাছে নেশার মতো।’
মো. মনজুরুল আলম, নিজস্ব প্রতিবেদক, কালচার অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট