কর্মীর লেখা

আমার বোকা মা!

প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

আমার মা–টা না খুব বোকা। কথায় কথায় কাঁদে। আমি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে কাঁদবে, আবার খারাপ করলাম, তখনো কাঁদবে। খুশি হলেও কাঁদবে, রাগ হলেও কাঁদবে, কষ্ট পেলেও কাঁদবে। শেষ কবে তাকে হাসতে দেখেছি, মনেই পড়ে না। তবু আমার মা দুনিয়ায় সেরা মা।

আমি যে বড় হয়েছি, এটা সে মানতেই চায় না। আমি বাংলাদেশের সেরা গণমাধ্যমের মানবসম্পদ বিভাগে চাকরি করি। কতশত বড় বড় মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা আমার। তারপরও রাস্তা পার হওয়ার সময় আমার মা আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখবে, হাত ধরে রাস্তা পার করাবে। যেন আমি তিন–চার বছরের ছোট বাচ্চা মেয়ে। মায়েরা হয়তো এমনই হয়। মায়েদের কাছে সন্তানেরা কখনো বড় হয় না। সত্যি আমি অনেক ভাগ্যবতী, এই বোকা মেয়েটা আমার মা বলে।

আমার কোনো ভাই না থাকায় বাবার কিছুটা আক্ষেপ থাকলেও আমরা বোনেরা কখনো মা–বাবাকে ছেলের অভাব বুঝতে দিইনি। মায়ের অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো আক্ষেপ নেই। আমার মা দুনিয়ায় সবচেয়ে সরল মানুষগুলোর একজন। সে এতটাই সরল যে আমরা খুব সহজে তাকে বোকা বানাতে পারি। বাবার শাসন থেকে বরাবর আমাদের রক্ষা করে এসেছেন এই মা। মা আমাদের সেই ঢাল, যাঁকে সব সময় ব্যবহার করা যায় বাবার শাসন থেকে বাঁচতে।    

আমি মনে করি প্রত্যেক মা এক একটা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক। আমি মায়ের কাছ থেকে সেই ব্যবস্থাপনা শিখি, যা আমার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি শেখাতে পারেনি।

সব সময় মায়ের কাছে ছিল আমার যত আবদার। এটা খাব না, ওটা রান্না করো। ঈদে এই জামাটা নেব, ওই জুতাটা লাগবে। আরও যে কতশত আবদার যে করি মায়ের কাছে! বাবা আমার রাশভারী লোক, তাই বাবার কাছে চাইতে, কোনো কিছু শেয়ার করতে বেশ ভয় পেতাম সব সময়। আমার বোকা মা–টা কেমনে জানি আমার রাগী বাবাকে ম্যানেজ করে ফেলত। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের জিনের মতো আমাদের সব ইচ্ছে পূরণ করত। আমার মা আমার দেখা সেরা ম্যানেজার। কীভাবে জানি একা হাতে সব ম্যানেজ করে ফেলত। এই তো সেদিন এক বান্ধবীর গায়েহলুদ ছিল, অনুষ্ঠান রাতে। তাই রাতে থাকতে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু আমার বাবা কখনোই রাতে বাসার বাইরে থাকার অনুমতি দেবেন না, এটা আমার জানা। তাই মন খারাপ করে বসে আছি, মা মন খারাপ কেন জানতে চাওয়ায় বললাম সবটা। মা কীভাবে জানি রাজি করিয়ে ফেলল বাবাকে। আমি ভাবি আমার মা বোকা নয়, আমার মা জাদু জানে।  

আজও মন খারাপ হলে, কষ্ট পেলে মায়ের কোলে মাথা রেখে সবটা শেয়ার করি। আমার এই বোকা মা–টার কাছে সবকিছুর সমাধান পাই। কত কিছু যে জানে, তার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সমস্যার সমাধান দেয় আমাদের।

তোমার মতো করে রাস্তা পার হওয়ার সময় ছেলে–মেয়ের হাত শক্ত করে ধরা শেখা বাকি, তোমার মতো রান্না শেখা বাকি, তোমার মতো করে ম্যানেজ করা শেখা বাকি, বুকের ভেতর সন্তানের জন্য এক সমুদ্র আবেগ জমানো বাকি।

আমার মা আমার দেখা সেরা ব্যবস্থাপক। আমি মনে করি প্রত্যেক মা এক একটা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক। আমি মায়ের কাছ থেকে সেই ব্যবস্থাপনা শিখি, যা আমার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি শেখাতে পারেনি। আমি মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগে কাজ করি, এটা আগেও বলেছি। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি মায়ের কাছ থেকে শেখা ব্যবস্থাপনা আমার কাছে বেশি প্র্যাকটিক্যাল মনে হয়। একটা সংসার, সংসারের মানুষগুলোকে ম্যানেজ করার সঙ্গে আমার প্রতিদিনের অফিসের কাজের মিল খুঁজে পাই।

প্রায়ই আমি ভাবি, মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে সামাজিক নিয়মে আমাকেও সামলাতে হবে নিজের সংসার। যেই সংসারে হয়তো আমিও আমার ছেলে-মেয়ের বোকা মা হব। যে অধ্যায়টা আমার জন্য একদম নতুন হবে।

ভয় হয় মা, আমি পারব তো তোমার মতো বোকা মা হতে, ভালো ব্যবস্থাপক হতে, তোমার মতো করে হয়তো পারব না মা। আবার ভাবি তুমি যেমন পেরেছ, আমি পারব মা। কারণ, আমি যে দুনিয়ার সব থেকে সেরা মায়ের সন্তান। তবে হ্যাঁ, এখনো যে অনেক কিছু শেখা বাকি, তাই সারা জীবন তোমাকে আমার প্রয়োজন মা। তোমার মতো করে রাস্তা পার হওয়ার সময় ছেলে–মেয়ের হাত শক্ত করে ধরা শেখা বাকি, তোমার মতো রান্না শেখা বাকি, তোমার মতো করে ম্যানেজ করা শেখা বাকি, বুকের ভেতর সন্তানের জন্য এক সমুদ্র আবেগ জমানো বাকি। আরও কত কিছু বাকি মা। আমি ঠিক তোমার কার্বন কপি হতে চাই। কারণ, তুমিই আমার দেখা সেরা মানুষ, আমার সব থেকে প্রিয় মানুষ, আমার জীবনের সেরা শিক্ষক। আমার আদর্শ। ভালোবাসি মা তোমাকে অনেক।

ঝর্না আক্তার শোভা, জুনিয়র এক্সিকিউটিভ, মানবসম্পদ বিভাগ