বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর একটি। এর ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে আসছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর মিলিত প্রবাহ ও বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অবস্থান দেশটিকে প্রায়ই বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি করে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়ের কারণে পরিবেশগত সমস্যাগুলো ক্রমেই বেড়ে চলেছে। শিল্পায়ন, দ্রুত নগরায়ণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহারের ফলে দেশের পরিবেশের ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পরিবেশগত টেকসই অবস্থা ও উন্নয়নের ওপর আলোকপাত করা জরুরি।
ভূপ্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর সম্মিলিত প্রবাহের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১১ দশমিক ৭ গুণ বেশি পানি নিষ্কাশিত হয়। ফলে বড় বন্যার সময় প্রায় ২২০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় দেড় শতাংশ। পাশাপাশি, ঘূর্ণিঝড়ও দেশের উপকূলীয় এলাকায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উপকূলীয় অঞ্চলে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় প্রায় ১ শতাংশ সাইক্লোনিক ঝড় আঘাত হানে, যা এই অঞ্চলকে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট বিপদ যেমন বায়ু ও পানিদূষণ দেশের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য প্রধান শহরে বায়ুদূষণ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। যানবাহন, শিল্পকারখানার ধোঁয়া এবং নির্মাণকাজের ফলে ঢাকার বায়ু সব সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানের নিচে থাকে। বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হয়। বিশেষ করে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে বায়ুদূষণ, যা শিশুদের আইকিউ হ্রাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করতে হলে একটি কার্যকর ও সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।
নদী ও খালের পানিদূষণ বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী একসময় শহরের প্রধান পরিবহন ও বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত হতো, বর্তমানে শিল্পবর্জ্য এবং গৃহস্থালির ময়লার কারণে বিষাক্ত জলাধারে পরিণত হয়েছে এই নদী। শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পানিতে মিশে জনস্বাস্থ্য, কৃষি এবং সামগ্রিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
সম্প্রতি প্লাস্টিক দূষণও বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশে প্রতিবছর প্রায় ৮ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার প্রায় ৩৬ শতাংশ পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়। প্লাস্টিকের এই বর্জ্য শহরের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা বন্ধ করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে এবং বন্যার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে তা মানবস্বাস্থ্যেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। যদিও ২০০২ সালে বাংলাদেশ একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছে, এর কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
নগরায়ণ এবং জলাভূমির পরিমাণ হ্রাস বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। শহরাঞ্চলে জলাভূমি ভরাট করে নির্মাণকাজ চালানোর ফলে জলাবদ্ধতা, পানিনিষ্কাশনের সমস্যা ও মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়া সংক্রমণ বেড়ে চলেছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। শহরের অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব দেশের পরিবেশগত অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলছে।
গত তিন দশকে বাংলাদেশ সরকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানে নানা নীতিমালা এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে এসব নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়নে প্রায়ই ঘাটতি দেখা যায়। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রায়ই পরিবেশগত দিক উপেক্ষিত হয়, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত টেকসই অবস্থায় প্রভাব ফেলে। উদাহরণ হিসেবে বন্যাপ্রবণ এলাকায় নির্মাণকাজ, নদীর তীর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ এবং সংরক্ষিত বনভূমি উজাড় করে শিল্প স্থাপন পরিবেশগত সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করছে।
সুন্দরবনের মতো সংরক্ষিত বনভূমিতে কয়লাভিত্তিক মেগা পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এই বনভূমি দেশের উপকূলীয় অঞ্চলকে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা থেকে রক্ষা করে এবং স্থানীয় মানুষদের জীবিকা নির্ভরশীলতার উৎস হিসেবে কাজ করে। বনভূমি উজাড়ের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে, যা দেশের বাস্তুতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন তীব্র আবহাওয়ার ঘটনা দেশের কৃষি, অবকাঠামো এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ঝুঁকির মুখে পড়েছে, যার ফলে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কৃষির ওপরও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো এবং জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি পদ্ধতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত ও টেকসই কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা অপরিহার্য। প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা, যেমন বনভূমিতে বৃক্ষ পুনঃরোপন, টেকসই মৎস্য চাষ এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি উৎসের ব্যবহার পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। বিশেষ করে নবায়নযোগ্য শক্তি, যেমন সৌর, বায়ু ও জৈব শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে পরিবেশগত ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীলতার উন্নয়ন করতে হবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। একটি কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা বর্জ্য কমানো, পুনর্ব্যবহার ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ওপর ভিত্তি করে টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করা যেতে পারে। শিল্প ও নগরায়ণে বায়ু ও পানিদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতিমালা প্রয়োগ করতে হবে, যাতে পরিবেশগত সমস্যার দ্রুত সমাধান হয়।
বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করতে হলে একটি কার্যকর ও সমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। সরকার এবং জনগণের যৌথ উদ্যোগে পরিবেশগত সমস্যার সমাধানে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার উদ্যোগ নিলে তা আরও কার্যকর হতে পারে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
যদি বাংলাদেশ পরিবেশ রক্ষার জন্য টেকসই পদক্ষেপ নিতে পারে, তবে দেশটি বিশ্বে একটি রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে, যা ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ এবং টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
* শামসুদ্দিন শহিদ : ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি মালয়েশিয়ার পানি ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক