কর্মীর লেখা:

চোর নিয়ে যেভাবে ধারণা পাল্টে গেল

প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

শীতের সকাল। কোলাহল-হইচইয়ে ঘুম ভাঙল। উঠানে বাড়ির লোকজন কি নিয়ে যেন বলাবলি করছে। চোখ ডলতে ডলতে বাইরে বেরোতেই শিবলু ছুটে এসে খবরটা দিল, ‘জানিস? সাঈদদের বাড়িতে না চোর ধরেছে। চল দেখবি..’। কথাটা শুনেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। বিস্ময়ে নয়, ভয়ে। হ্যাঁ ভয়ে। চোর শব্দটাতেই আমার ভয়।

তাহলে খুলেই বলি। ছোটবেলা থেকেই (যদিও যখনকার কথা বলছি, তখন যে খুব বড় হয়ে গেছি, তা নয়। বয়স কত হবে? এই ধরুন চার-পাঁচ বছর) চোর বলতে আমার কল্পনায় যে ছবিটা ভাসত, তা হচ্ছে একটা হিংস্র প্রাণীর। যে কি না কামড়ে দিতে পারে। আর হবেইবা না কেন? কাঁদলে আম্মা আমাকে এই বলে ভয় দেখাত—‘কাঁদে না বাবা, চোর আসবে’। চোরের ভয়ে আমার কান্না থেমে যেত। কিন্তু চোরভীতি আমার এমনি এমনি আসেনি। তার পেছনেও কারণ আছে।

এই ঘটনা আমার চোরভীতি আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল। এত্ত বড় একটা গরু লালুকে যে প্রাণী গোয়ালঘর থেকে অনায়াসে তুলে নিয়ে যেতে পারে, সেটা নির্ঘাত ভয়ংকর হিংস্র প্রাণী।

একবার গ্রীষ্মে কালবৈশাখীর রাতে আমাদের গোয়াল থেকে লাল গরুটা (লালু) চুরি হয়ে গেল। বিকেলে শুরু হয়ে ঝড় থামল সন্ধ্যার পর। কিন্তু বৃষ্টি হলো প্রায় সারা রাত। রাতের খাওয়া শেষ হলে আম্মা রান্নাঘরে গোছগাছ সেরে লালুকে ভাতের মাড় দিতে গোয়ালঘরে গিয়ে দেখে লালু নেই। চিৎকার দিয়ে আম্মা বের হয়ে এল। আম্মার চিৎকারে ঘরের সবাই তো বটেই, আশপাশের ঘরের লোকও বের হয়ে এল। আব্বা, বড়দা আর আমার দুই চাচাতো ভাই টর্চ হাতে বৃষ্টির মধ্যেই লালুকে খুঁজতে বের হলেন। আম্মা আমাকে আর আমার ছোট বোনকে শুইয়ে দিয়ে দোয়াদরুদ পড়তে লাগলেন, যেন লালুকে পাওয়া যায়।

এই ঘটনা আমার চোরভীতি আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল। এত্ত বড় একটা গরু লালুকে যে প্রাণী গোয়ালঘর থেকে অনায়াসে তুলে নিয়ে যেতে পারে, সেটা নির্ঘাত ভয়ংকর হিংস্র প্রাণী। ঝড়ের সেই রাতে আমার ঘুম হলো না, চোরের ভয়ে। কাঁথার ভেতর কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে থাকলাম। লালুকে অবশ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, মাইলখানেক দূরে এক ধানখেতে।

সেই রাতের লোমহর্ষক (আমার কাছে তো বটেই) চুরির ঘটনা প্রায় ভুলেই গেছি। এরই মধ্যে ঘটল আরেক ঘটনা। আমাদের ঘরের পেছনে কুয়ার মতো একটা গর্ত করা হয়েছিল, যদিও পরে সেই কুয়া আবার বন্ধ করে ফেলা হয়েছিল, কিন্তু কি কারণে আমার জানা নেই। এক সকালে বাড়ির লোকজন কি নিয়ে যেন হইচই শুরু করল। ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা করলাম—‘কী হয়েছে’? ভাইয়া যা শোনাল, তাতে আমার গলা আরেক দফা শুকিয়ে গেল। আবারও চোর। একটা চোর নাকি ওই গর্তে পড়ে গেছে।

আমি খুব হতাশ হলাম। কষ্টও পেলাম। চোর–সম্পর্কিত ধারণা পাল্টে যাওয়ায় নয়, বরং এটা ভেবে—মানুষ কী করে চোর হয়?

কী সাংঘাতিক কথা! আগেরটা ছিল ‘গরুচোর’ এবারেরটা ‘মুরগিচোর’। পাটের দড়ি আনা হলো, গর্ত থেকে চোর টেনে তোলার জন্য। ছয়জন মিলে অনেক চেষ্টা চরিত্র করার পর চোরটাকে তুলল। আমি দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখলাম। ভয়ে কাছে গেলাম না। কিন্তু সেই চোরের চেহারা আমার কাছে পরিচিত মনে হলো। চেহারাটা হিংস্র, সামনে তীক্ষ্ণ দাঁত। চোখে যেন আগুন জ্বলছে। গর্ত থেকে উঠেই এক দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর চলে গেল। দেখতে শেয়ালের মতো। চোর–সম্পর্কিত আমার ধারণা আরও পাকাপোক্ত হলো।

কিন্তু সেদিন শীতের সকালে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে শিবলুর পেছন পেছন রওনা হলাম সাঈদদের বাড়ির দিকে। সাঈদদের উঠানে অনেক লোকের ভিড়। শিবলুর সঙ্গে ভিড় ঠেলে ভেতরে গিয়ে আমি রীতিমতো টাশকি খেলাম। চোর কোথায়? ঘরের খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা লোক। একজন মানুষ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যথেষ্ট উত্তম-মধ্যম দেওয়া হয়েছে। মাথা নিচু করে লোকটা মাটিতে বসে আছে। তার হাত পেছন দিক থেকে খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। লুঙ্গি পরা লোকটার গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। গেঞ্জির এখানে-ওখানে ছেঁড়া। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। পায়ে স্যান্ডেল-জুতা কিছু নেই। মাটিতে ফেলে লোকটাকে নিশ্চয়ই পেটানো হয়েছে; কারণ, তাঁর শরীরে এখানে–ওখানে মাটি লেগে আছে।

আমি শিবলুকে জিজ্ঞাসা করলাম—‘চোর কোথায়’? শিবলু বিরক্ত হয়ে বলল—‘আরে দেখতে পাচ্ছিস না, সামনে বাঁধা’? আমি খুব হতাশ হলাম। কষ্টও পেলাম। চোর–সম্পর্কিত ধারণা পাল্টে যাওয়ায় নয়, বরং এটা ভেবে—মানুষ কী করে চোর হয়?

মামুনুর রহমান খাঁন, তথ্যপ্রযুক্তি