পানি ব্যবস্থাপনায় আমাদের যেদিকে নজর দিতে হবে

মাসফিকুস সালেহীন
মাসফিকুস সালেহীন

একদিকে আমাদের দেশটি দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত, অন্যদিকে এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করে দারিদ্র্য হ্রাস এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে দেশটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো নীতি ও পরিকল্পনা, যার মধ্যে অন্যতম হলো জাতীয় পানিনীতি, জাতীয় পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা, জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় পরিকল্পনা। এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি রূপকল্প পরিকল্পনা—বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এবং জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান)। 

বাংলাদেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিগত তিন দশকে বড় পরিবর্তন ঘটেছে। পরিকল্পনা ও নীতিগুলো আগের ‘পানি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ’ থেকে সরে এসে ‘পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা’র ধারণা গ্রহণ করেছে, এবং পরবর্তী সময়ে তা রূপ নিয়েছে ‘সমন্বিত পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনায়’। তবে বলাই বাহুল্য, ঝুঁকি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ আমাদের এখনো প্রচুর এবং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অধিকতর তীব্র ও ঘন ঘন দুর্যোগের আবির্ভাব এবং আমাদের কিছু সমন্বয়হীন ও অপরিকল্পিত কৌশলের কারণে।

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা এই তিনটি নদ–নদীর বেসিনের উজান থেকে আমাদের দেশে প্রবেশ করা পানির পরিমাণের (বর্ষাকালে যা দেশের মোট পানির ৮০% এরও বেশি) ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, যা বাংলাদেশের নদীবাহিত বন্যার প্রধান কারণ। শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রাপ্যতা আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয়, যা নির্ভর করে উজানের দেশগুলোতে পানি ব্যবহারের পরে এ দেশে কতটুকু পানি ঢুকবে, তার ওপর। 

যমুনা ও পদ্মার মতো বড় নদী এবং একই সঙ্গে উপকূলীয় নদীগুলোর পাড়ভাঙন জনগণের দুর্ভোগের একটি বড় কারণ। ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা এবং ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজের কারণে উপকূলীয় নদীতে শুষ্ক মৌসুমে মিঠাপানি হ্রাসের ফলে নদী ও মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া সুন্দরবন, কৃষি ও নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য উদ্বেগের কারণ। আর্সেনিকের উপস্থিতি এবং ভূগর্ভস্থ জলের ওপর অত্যধিক নির্ভরতার কারণে ভূগর্ভস্থ জলের স্তরের হ্রাস সেচযুক্ত কৃষি এবং নিরাপদ পানি সরবরাহের সমস্যাকে অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। 

ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাস তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি উপকূলীয় মানুষের দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অপরিকল্পিত বাঁধ ও শুষ্ক মৌসুমে উজান থেকে আসা পানি হ্রাসের কারণে উপকূলীয় নদীগুলোর গর্ভে অতিরিক্ত পলি জমে উঁচু হওয়ায় উপকূলীয় পোল্ডারগুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। স্পষ্টতই, আমরা কিছু অপরিকল্পিত হস্তক্ষেপের বিরূপ প্রভাব অনুভব করেছি। আমাদের মনে রাখা দরকার, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের বিদ্যমান প্রতিকূলতাকে আরও বেশি প্রতিকূল করে তুলবে, যার লক্ষণগুলো ক্রমে দৃশ্যমান।

আমরা জানি, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমন্বিত ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। এর অর্থ হলো, এমনভাবে পরিকল্পনা করা, যাতে এক উদ্দেশ্যে পানির ব্যবহার বা ব্যবস্থাপনার কারণে; অন্য উদ্দেশ্যে পানি ব্যবহার বা ব্যবস্থাপনা ব্যাহত না হয়; বরং সহায়ক হয় এবং পরিবেশগত, আর্থসামাজিক এবং ধনী-দরিদ্রের সাম্যতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। 

আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনায় অপরিকল্পিত কৌশল (যেমন অপরিকল্পিত বাঁধ) ধনী কৃষককে উপকৃত করলেও জেলে এবং প্রান্তিক কৃষকদের মতো দরিদ্র মানুষকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। 

আমাদের প্রয়োজন, নদী-প্লাবনভূমির সংযোগ পুনরুদ্ধারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া, যাতে প্লাবনভূমির উপকারিতাগুলো আমরা পুনরুদ্ধার করতে পারি, যার মধ্যে রয়েছে বন্যা উপশম, শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহের উন্নতি এবং মৎস্য ও অন্যান্য জলজ বাস্তুতন্ত্র (ইকোসিস্টেম) এবং সংশ্লিষ্ট বাস্তুতন্ত্র পরিষেবা (ইকোসিস্টেম সার্ভিস) বজায় থাকা। সমন্বিত বন্যা ব্যবস্থাপনার মূলে রয়েছে কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত কৌশলের
সমন্বয়, যাতে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কম হয় এবং একই সঙ্গে প্লাবনভূমির সর্বোচ্চ উপকারিতা নিশ্চিত করা যায়।

বন্যার পূর্বাভাস বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অকাঠামোগত বন্যার ঝুঁকি হ্রাসের ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি, যেটিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র প্রশংসনীয় কাজ করে চলেছে। বড় বেসিনের অংশ হওয়ায় ভারত থেকে প্রাপ্ত হাইড্রোলজিক ডেটা ব্যবহার করে যমুনা ও গঙ্গা নদীর বিভিন্ন স্থানে এক-পাঁচ দিনের আগাম পূর্বাভাস দেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজতর। 

তবে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার (ফ্ল্যাশ ফ্লাড) পূর্বাভাস এখন পর্যন্ত একটি বড় চ্যালেঞ্জ; বৃষ্টির পর বন্যার স্বল্প সময়ে আবির্ভাব এবং বৃষ্টির পূর্বাভাসের অনিশ্চয়তার কারণে এখনো এক দিনের বেশি আগাম ভালো পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। মেশিন লার্নিং (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে আকস্মিক বন্যার পূর্বাভাসের জন্য নদীর পানির লেভেলের সঠিক পূর্বাভাসের চেয়ে আকস্মিক বন্যা হবে কি না, তার পূর্বাভাস বেশি জরুরি। 

বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্লাবনভূমির কোন জায়গায় পানির গভীরতা কত হতে পারে এবং এর জন্য সম্ভাব্য কী ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে, তার স্থানীয় পূর্বাভাস (ইমপ্যাক্ট-বেজড ফোরকাস্টিং) দেওয়া এবং বন্যায় সম্ভাব্য আক্রান্ত মানুষকে আগাম অর্থসহায়তা দিয়ে (ফোরকাস্ট-বেজড-ফাইন্যান্সিং) তাদের আগাম প্রস্তুতির (অ্যান্টিসিপেটরি অ্যাকশন) সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যাতে তারা আসন্ন ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমাতে পারে। 

আন্তর্জাতিক মানবিক সংগঠনগুলো এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় যথাক্রমে ফোরকাস্ট-বেজড-ফাইন্যান্সিং এবং ইমপ্যাক্ট-বেজড ফোরকাস্টিংয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছে এবং একাডেমিক ইনস্টিটিউট (যেমন বুয়েট) এই প্রচেষ্টায় গবেষণা সহায়তা দিচ্ছে। 

একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষায় বৃষ্টি বৃদ্ধির ফলে ওপরের বেসিনগুলো থেকে আগত পলির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে ড্যাম বা ব্যারাজের মতো হস্তক্ষেপের কারণে পলি আটকে গিয়ে পলি প্রবাহের পরিমাণ কমতে পারে। গবেষণা বলছে, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা উভয় নদ–নদীতে পলিপ্রবাহে ক্রমহ্রাসমান প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি টেকসই ডেল্টা নির্মাণ প্রক্রিয়ায় একটি সম্ভাব্য বাধা, যেটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উপকূলীয় ভূমি হ্রাসের ভারসাম্য বজায় রাখার ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জকে আরও বাড়িয়ে দেবে। 

উপকূলীয় নদীগুলোতে পলি পরিবহন এবং অবক্ষেপণ (সেডিমেন্টেশন) প্রক্রিয়া সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে ভবদহসহ অন্যান্য স্থানে জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। বুয়েটের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, যে জোয়ার-ভাটার অসমতার (টাইডাল অ্যাসিমেট্রি) কারণে কিছু কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় নদীর বুকে অনেক বেশি পলি জমে, এবং এটি সম্পর্কে নতুন জ্ঞান সম্ভাব্য কৌশলগুলো, যেমন ‘টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট’, স্ট্র্যাটেজিক ড্রেজিং, পাম্পের মাধ্যমে পানিনিষ্কাশন, এগুলোর কোনটি কোন স্থানে কাজ করবে, সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেবে।

গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ৫০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে উপকূলীয় প্লাবন এলাকা ১১-১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে নতুন বড় প্রকল্প নেওয়ার চেয়ে বেশি প্রয়োজন পোল্ডার বাঁধগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং বাঁধগুলোর উচ্চতা যথাসম্ভব সেগুলোর নকশা অনুযায়ী বজায় রাখার চেষ্টা করা। এটি অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ বাজেটের কারণে সম্ভব হচ্ছে না। 

পদ্মা ও যমুনার মতো বড় নদী এবং একই সঙ্গে উপকূলীয় নদীগুলোর ভাঙন জনগণের দুর্ভোগের একটি বড় কারণ

এ কারণেই আমরা একটি মধ্যম শক্তির সাইক্লোন আম্পানের পরে একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল শক্তির সাইক্লোন ইয়াসে বাঁধের প্রায় একই রকম ক্ষয়ক্ষতি দেখতে পাই। রক্ষণাবেক্ষণ বাজেটের অপ্রতুলতার সমস্যা সমাধান করা টেকসই উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারের দাবি রাখে। 

গবেষণা বলছে যে জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষার জন্য বাঁধের সঙ্গে একসঙ্গে একটি হাইব্রিড ‘নেচার-বেজড সলিউশন’ হিসেবে উপকূলীয় বনায়নকে ব্যবহার করা যায়। বনায়ন ঝড়ের ঢেউয়ের শক্তিকে যথেষ্ট (প্রায় ৫০ শতাংশ) পরিমাণে কমাতে পারে এবং এতে বাঁধের ক্ষতি ও জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের উচ্চতা হ্রাস পেতে পারে। 

তবে গবেষণা এটিও বলছে যে শুধু পোল্ডারের বাঁধ টেকসই করলেই চলবে না, পোল্ডারের অধিবাসী সবার উপকারের জন্য একই সঙ্গে ভেতরের পানি ব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত জরুরি, যার মধ্যে রয়েছে ড্রেনেজ ও সেচ খালগুলো সচল রেখে জলাবদ্ধতা এবং লবণাক্ততা দূর করা। এর জন্য প্রয়োজন স্থানীয় জল ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলোকে সচল ও উদ্বুদ্ধ রাখা, স্থানীয় দ্বন্দ্ব নিরসন করা এবং যার যার ভূমিকা তা পালন নিশ্চিত করা।

পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার একটা মূলমন্ত্র হতে হবে ‘সিস্টেমস অ্যাপ্রোচ’। ভৌত অবকাঠামো, ইকোসিস্টেম, মানুষের জীবিকা এবং ইনস্টিটিউশন হলো তার উপাদান। সিস্টেমে এগুলোর ভূমিকা এবং কীভাবে এগুলো একটি অন্যটি সঙ্গে যুক্ত তা বোঝা অতি জরুরি। জানা প্রয়োজন, কোন কৌশল বা প্রকল্পের কারণে সিস্টেমে কী প্রভাব পড়বে, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হবে নেতিবাচক বা ইতিবাচক। 

সর্বোপরি জানা জরুরি, কোন মানুষেরা উপকৃত হবেন আর কোন মানুষেরা বঞ্চিত হবেন। এর জন্য প্রয়োজন ‘ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম অ্যাসেসমেন্ট’ মডেল, যা ইন্টিগ্রেটেড প্ল্যানিং বা সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরিতে সহায়ক হবে। পরিকল্পনা তৈরির সময় ইকোসিস্টেম ও জীববৈচিত্র্য এবং সামাজিক সাম্যতা বিশেষ গুরুত্ব পাবে। কারণ, গবেষণা বলছে দরিদ্র মানুষের ইকোসিস্টেম সার্ভিসের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। ডেলটা প্ল্যান বাস্তবায়নে ইন্টিগ্রেটেড প্ল্যানিং বা কৌশল নির্ধারণে ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেম অ্যাসেসমেন্ট এখনো খুব ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ বিষয়ে নজর দেওয়া বিশেষভাবে জরুরি।

মাসফিকুস সালেহীন: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।