তুচ্ছ বিষয় নিয়ে দুই পরিবারে ঝগড়া। জেরে ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রতিপক্ষ। আসামিদের মধ্যে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের চার শিশুও আছে। যেদিন রায় হবে, সেদিন ভয়েই ছিল তাদের পরিবার, রায়ে না জানি বাচ্চাগুলোর কী শাস্তি হয়। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে চার শিশুকেই প্রবেশনে পরিবারের কাছে ফেরত পাঠান সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এবং শিশু আদালতের বিচারক জাকির হোসেন।
সুনামগঞ্জে গত দুই বছরে এ ধরনের ১৯৯টি মামলায় ২৬৮ শিশুকে প্রবেশনে দিয়েছেন এই বিচারক। ভালো কাজের শর্তে এসব শিশু এখন পরিবারের কাছে আছে।
ব্যতিক্রমী এসব রায় সম্পর্কে জাকির হোসেন বলছিলেন, ‘মামলাগুলো দেখে মনে হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়রানির জন্য ছোটদের আসামি করা হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো ছোটখাটো অপরাধ করতেও পারে। আবার না-ও করতে পারে। আবার এদের আসামি দিতে অন্যের প্ররোচনাও থাকতে পারে। মামলার আসামি হয়ে এসব শিশু যখন আদালতে আসে, তখন নিজের সন্তানের কথা ভাবি। শাস্তি দেওয়াই তো বিচারকের মূল উদ্দেশ্য নয়; মূল উদ্দেশ্য সংশোধন। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো। শিশুর বিকাশ, বেড়ে ওঠার উপযুক্ত জায়গা তো পরিবার। সংশোধনের জন্য তাদের তাই পরিবারের কাছেই পাঠাই।’
এই বিচারক বলছিলেন, ‘শিশু আইনে বলা আছে, তাদের বিচারের প্রক্রিয়া ভিন্ন। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা। সংশোধনের সুযোগ দেওয়া। সংশোধনের জন্য তো একটা পরিবেশ দরকার। তাদের যদি সংশোধনাগারে পাঠানো হয়, তাহলে অন্য অপরাধীদের সঙ্গে থেকে তারা আরও মন্দ কাজে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।’
প্রবেশনে থাকা শিশুদের বেশ কিছু শর্ত পালন করতে হয়। প্রতিদিন একটি ভালো কাজ করে সেগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখা। মা-বাবার কথা শোনা, তাদের সেবাযত্ন করা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ, অসৎসঙ্গ ত্যাগ, মাদকমুক্ত থাকা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই পড়া, গাছ লাগানো–পরিচর্যা, নিজেকে আর অপরাধে না জড়ানো। শর্তগুলো শিশুরা ঠিকমতো পালন করছে কি না, তা তত্ত্বাবধান করেন জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা। তিন মাস পরপর আদালতে প্রতিবেদন দেন তিনি। এ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই চূড়ান্তভাবে মামলার দায় থেকে মুক্ত হয় শিশুরা। এ পর্যন্ত ৫১টি মামলায় প্রবেশনে থাকা ৬২ শিশু আদালতের শর্ত মেনে পুরোপুরি মামলার দায় থেকে মুক্ত হয়েছে। অন্যদের প্রবেশন চলছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হওয়ায় সাত শিশুকে গাজীপুরের কিশোর সংশোধনাগারে যেতে হয়েছে। এই শিশুরা ‘জেল’ খেটে আবার বাড়ি এসে শর্ত পালনের চেষ্টা করছে।
সুনামগঞ্জে ছাতক উপজেলার একটি গ্রামের বাসিন্দা ৪৮ বছর বয়সী সফিক মিয়া (ছদ্মনাম)। ২০০৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা করেন স্ত্রী রোশনা বেগম (ছদ্মনাম)। সফিক মিয়ার পরিবারের আরও দুজনকে আসামি করেন। তখন তাঁদের মেয়ের বয়স ছিল পাঁচ বছর। মামলার পর থেকেই মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আছেন রোশনা। এখন মেয়েটা কলেজে পড়ে। মামলাটি দেখে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন জাকির হোসেন। একপর্যায়ে আপসে নিষ্পত্তিতে রাজি হন তাঁরা। গত ২২ জুলাই তাঁদের মামলাটি আপসে নিষ্পত্তি হয়েছে। দুজনই বাড়ি ফিরে গেছেন। সফিক মিয়া বলছিলেন,‘বোঝাইতাম পরতাম না, অত দিন কী অশান্তিত আছলাম। মেয়েটারে নিয়া বাকি দিনগুন শান্তিতে থাকতাম চাই।’
২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত এ রকম ২২৫টি মামলা আপসে নিষ্পত্তি করে ২২৫টি পরিবারকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন জাকির হোসেন।
এই বিচারক বলছিলেন, যেসব মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে, সেগুলো আপসযোগ্য। মামলাগুলো তাঁর কাছে আসার পর সেগুলো তিনি বাছাই করেন। দুই পক্ষের সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলেন। মামলার কুফল, একসঙ্গে পরিবারে থাকার সুফল, সন্তানদের ভবিষ্যৎ—এসব বিষয়ে তাঁদের সচেতন করেন। কখনো পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয়। দুই পক্ষ সম্মত হলেই মিলমিশের সুযোগ দেওয়া হয়। মাঝখানে নির্ধারিত একাধিক তারিখে তাঁদের আদালতে আসতে হয়। এ সময়ও তাঁদের সম্পর্কের উন্নতি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয়। এরপরই আপসে নিষ্পত্তি করে মামলার দায় থেকে আসামিদের খালাস দেওয়া হয়। জাকির হোসেন আরও বলছিলেন, ‘জোর করে তো আর জোড়া লাগানো যাবে না। যারা আগ্রহী হয়, তাদের ক্ষেত্রেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়।’
কিন্তু একসঙ্গে এত রায় কেন? জাকির হোসেন বলেন, একসঙ্গে হলে মানুষ জানে। দেখে অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। মানুষ জানল রায় হয়, বিচার হয়, শাস্তি যেমন হয়, তেমনি খালাসও পায়। মামলা নিষ্পত্তি হয়। আইনের উদ্দেশ্য তো শুধু শাস্তি দেওয়া নয়।
বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার হুসনাবাদ গ্রামে জাকির হোসেনের বাড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে বিসিএসের মাধ্যমে ১৯৯৯ সালে সহকারী জজ হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার।
লেখক:প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ