১৫ জুলাই ২০২৪। সেদিন নির্ধারিত কোনো অ্যাসাইনমেন্ট ছিল না। নির্দেশনা ছিল, যেকোনো সময় প্রয়োজনে ঘটনাস্থলে ছুটতে হবে। বেলা দেড়টার দিকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় যেতে বলা হলো। অথচ অফিসেই থাকব ভেবে সেদিন স্যান্ডেল পরে কাজে বেরিয়েছিলাম। মোটরসাইকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে যেতে ভাবছিলাম, বিক্ষোভ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ—এসবের মধ্যে কাজ করতে তো কোনো প্রস্তুতি নেই।
হাতিরপুল হয়ে কাঁটাবন মার্কেটে পরিচিত একটি দোকানে মোটরসাইকেল রেখে হেলমেট সঙ্গে নিলাম। পরিস্থিতি জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই অবস্থান করা সহকর্মী আহমদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতেই দেখি, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠি, রড, স্টাম্প—এসব নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
ভিসি চত্বর হয়ে টিএসসিতে গিয়ে দেখি, ততক্ষণে এলাকাটি ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের দখলে। তাঁরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। এতে কেউ মাথায়, কেউ হাতে, কেউবা শরীরে আঘাত পেয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হচ্ছিল।
বিকেল চারটার দিকে জানা গেল, শিক্ষার্থীরা সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে (এস এম) অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাতে দলবল নিয়ে রওনা হন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। টিএসসি থেকে শহীদ মিনার হয়ে এস এম হলের দিকে যাওয়া ছাত্রলীগের একটি মিছিলের পিছু নিই। হঠাৎ মিছিলের শেষ ভাগে থাকা ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী রিকশায় যাওয়া এক ছেলেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে মারধর করতে শুরু করেন। ছেলেটি ফুটপাতে শুয়ে পড়লে তাঁকে লাঠিসোঁটা দিয়ে মাথায় আঘাত শুরু করেন তাঁরা। তখন সেখানে থাকা সংবাদকর্মী ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা এগিয়ে গিয়ে ছেলেটিকে রক্ষা করেন। এক ফল বিক্রেতা নিজের পরনের শার্ট খুলে ছেলেটির মাথায় বেঁধে দেন। পরে ওই ফল বিক্রেতাই ছেলেটিকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান।
১৬ জুলাই ও ২ আগস্ট সায়েন্স ল্যাব এলাকায়, ১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে, ২০ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে, ৩ আগস্ট গুলশানে এবং ৫ আগস্ট মোহাম্মদপুর ও বঙ্গভবন এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছি। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়েছি প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহের কাজে।
সায়েন্স ল্যাব এলাকায় ১৬ জুলাই ও ২ আগস্ট দায়িত্ব পালন করেছি। সেদিন দুপুরে গ্রিন রোড থেকে কয়েকজন আন্দোলনকারীর সঙ্গে কথা বলে সায়েন্স ল্যাবের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি। সায়েন্স ল্যাবে যেতেই একদল লোক আমার মোটরসাইকেল ঘিরে ধরেন। নানা প্রশ্ন আর নেতিবাচক কথা বলা হচ্ছিল। কেন এসেছি, কী কাজ করলাম, আন্দোলন নিয়ে কী লিখেছি—এসব। কিন্তু কিছুরই জবাব দেওয়ার বা আমার জবাব কারও শোনার মতো পরিস্থিতি ছিল না।
একপর্যায়ে কেউ কেউ আমাকে মোটরসাইকেল থেকে নামানোর চেষ্টা করেন, কেউ কেউ কাঁধের ব্যাগ ধরে টানাটানি করেন, বোতলের পানি গায়ে ঢেলে দেন। অনাকাঙ্ক্ষিত ওই পরিস্থিতি আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা সামাল দেন। তাঁরা আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিলে মোটরসাইকেল চালিয়ে ফিরে আসার সময় আমাকে লক্ষ্য করে পেছন থেকে ইটপাটকেল ছোড়া হয়।
বিক্ষোভকালে ছররা গুলি ও অন্যান্য আঘাতে চোখ নষ্ট হওয়া মানুষের খোঁজে ঢাকার হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেছি। দেখেছি কত তরুণ চোখে ব্যান্ডেজ নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন, সেই ক্ষতিগ্রস্ত চোখ বেয়েই গড়িয়ে পড়ছে পানি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে গিয়েছিলাম দুই দিন—২৪ ও ২৬ জুলাই। প্রথম দিন সাড়ে ছয় বছর বয়সী রিয়া গোপের (গুলিতে নিহত) বাবা-খালার আহাজারি দেখে মনের অজান্তেই চোখের কোণে পানি জমে। দ্বিতীয় দিন সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদের বাবা নওশের আলীর কান্না দেখেছি।
৫ আগস্ট ছিলাম মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। সেদিন আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে গণভবনের দিকে অগ্রসর হয়। ততক্ষণে শেখ হাসিনা পালিয়েছেন।
* ড্রিঞ্জা চাম্বুগং: নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো