অনুযোগে মোড়ানো নিখাদ ভালোবাসা

প্রথম আলোর সার্কুলেশন বিভাগ ২০১৭ সালে ‘ডোর টু ডোর’ নামে মাসব্যাপী একটি কার্যক্রম হাতে নেয়। যার উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য পাঠককে প্রথম আলো পড়তে ও বাসায় রাখতে উদ্বুদ্ধ করা। সারা দেশের মতো উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি শহরে আমরা এই কার্যক্রম পরিচালনা করছিলাম। একদিন পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলা শহরে এক “প্রমোটর” সহকর্মীর সঙ্গে কাজ করছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কথা বলছি।

একটি বাড়ির কলবেল বাজাতেই দোতলার জানালা থেকে এক প্রবীণ আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় পেয়ে দরজা খুলে আমাদের দোতলায় নিয়ে গেলেন তিনি। ড্রয়িংরুমে বসতে দিয়েই শুরু করলেন বিরতিহীন প্রশ্ন। আমাদের নাম ও বাড়ি কোন জেলায় জানতে চাইলেন। প্রথম আলোতে আমরা কোন পদে আছি, কী কাজ করি, কত দিন কাজ করছি—একের পর এক প্রশ্ন। তখন আমার মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোক যেন আমাদের চাকরির ইটারভিউ নিচ্ছেন! এরই মধ্যে আমাদের জন্য চা এসেছে। এবার প্রশ্নপর্ব থামল। অল্পক্ষণ পরে ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিতে শুরু করলেন। ঈশ্বরদী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রামে তাঁর পৈতৃক বাড়ি। এখানে বসবাস করছেন প্রায় ১৩ বছর। পেশায় তিনি ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। এখন অবসর যাপন করছেন। এভাবে অনেক সুখ–দুঃখের কথা শোনালেন।

এসব আলাপচারিতায় প্রায় আধা ঘণ্টা শেষ। আমি আর আমার সহকর্মী একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছি বারবার। আমাদের সময় নষ্ট হচ্ছে। দিন শেষে বসকে রিপোর্ট দিতে হবে আজকে কতটি কল হয়েছে, প্রোডাক্টিভ কল কতটি, কত কপি সার্কুলেশন বাড়ল—এগুলোই আমাদের মাথায় কাজ করছিল তখন। এমন সময় ভদ্রলোক হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এক মিনিট। অন্য ঘরে গেলেন তিনি। ফিরে এলেন সেদিনসহ গত চার–পাঁচ দিনের প্রথম আলো হাতে। এবার পত্রিকাগুলো সামনে রেখে বলতে লাগলেন, প্রথম আলো আর আগের মতো নেই। আমি বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলাম, যেমন...?

তিনি রাগত স্বরে একের পর এক নেতিবাচক মন্তব্য করতে লাগলেন প্রথম আলো নিয়ে। কথা বলতে বলতে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। দুই-তিনবার মৃদু স্বরে তাঁকে উত্তেজিত হতে মানা করেছিলাম আমি। বললাম, আপনার সব কথা শুনব, আপনি শান্ত হয়ে বলতে থাকুন। আমার মনে হচ্ছিল তিনি যেন আমার কথা শুনতেই পাচ্ছিলেন না। এই পরিস্থিতিতে আমার কিছুটা ভয় করতে শুরু করল, এভাবে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলতে বলতে যদি তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তো ৫–৭ মিনিট বলার পরে তিনি থামলেন। গৃহকর্মীকে ডেকে এক গ্লাস পানি চাইলেন। পরে শান্ত কণ্ঠে আমাদের বললেন, আপনারা রাগ করেননি তো? আমরা হাসিমুখে ‘না’ বললাম। এবার তাঁর দুটি হাত আমাদের দুজনের মাথায় রাখলেন। অনেকটা আবেগপ্রবণ হয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘প্রথম আলো প্রকাশের দিন থেকেই নিয়মিত পড়ছি। তারও আগে থেকেই আমি নিয়মিত পত্রিকা পড়ি। প্রথম আলোকে কেন যেন নিজের পত্রিকা মনে হয়।

অনেক লেখা দেখে ভাবি, এটা বুঝি শুধু আমার কথা ভেবেই লিখেছে। প্রথম আলোকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি, তাই এত অভিযোগ আমার। আপনাদের সামনে পেয়ে মনের কথা বলতে পারলাম, খুব ভালো লাগছে।’ আমি বললাম, আপনার মতো এমন পাঠক যিনি কিনা শুরুর দিন থেকে প্রথম আলো পড়ছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমাদেরও খুব ভালো লাগছে। আমাদেরকে আবারও চা দেওয়ার জন্য গৃহকর্মীকে ডাকলেন। তাঁর সঙ্গে দুপুরে খেয়ে যেতে বললেন। আমরা ধন্যবাদ বলে বিদায় চাইলাম। তিনি নিজে সদর দরজা পর্যন্ত আমাদেরকে এগিয়ে দিলেন। পেছন থেকে বারবার বললেন, ভালো থাকবেন।

লেখক: জোনাল ব্যবস্থাপক, বগুড়া, সার্কুলেশন বিভাগ