রজতজয়ন্তীর বিশেষ লেখা

রাজ্জাক: নায়ক অনেক, নায়করাজ একজন

জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।

রাজ্জাক (২৩ জানুয়ারি ১৯৪২—২১ আগস্ট ২০১৭)
রাজ্জাক (২৩ জানুয়ারি ১৯৪২—২১ আগস্ট ২০১৭)

২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার আগে ৭ কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, এখন ১৭ কোটির ভালোবাসা পাচ্ছি, সামনে ২০ কোটি মানুষের ভালোবাসা নিয়েই চলে যেতে যাই।’ (প্রথম আলো, ১ মে ২০১৪)

২০১৭ সালের ২১ আগস্ট অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন রাজ্জাক। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আকাশ থেকে ঝরে পড়ে একটি নক্ষত্র, যার আলোর বিচ্ছুরণে সমৃদ্ধ হয়েছে এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্প।

এক্সট্রা থেকে সুপারস্টার

কলকাতার এক অবস্থাপন্ন পরিবারে জন্ম নেওয়া রাজ্জাক বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যে পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলা, নাটক, সিনেমা নিয়েই মেতে থাকতেন বেশি। তাঁকে সংসারে মনোযোগী করতে অভিভাবকেরা তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন। অচিরেই ঘরে আসে এক পুত্রসন্তান। ঠিক ওই সময়ই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছেয়ে ফেলে কলকাতার আকাশ-বাতাস। সেই দাঙ্গার সময় ১৯৬৪ সালে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় আসেন রাজ্জাক। প্রথমে স্টেডিয়াম, পরে কমলাপুর হয় তাঁর ঠিকানা। চিত্র পরিচালক আব্দুল জব্বার খান তাঁকে সহায়তা করেন ইকবাল ফিল্মসে সহকারী হিসেবে কাজের ব্যবস্থা করে। পরিচালক কামাল আহমেদের উজালা (১৯৬৬) ও পরওয়ানা (১৯৬৬) ছবিতে সহকারীর কাজ করেন রাজ্জাক। পরে আখেরী স্টেশন (১৯৬৬), কার বউ (১৯৬৬), ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন (১৯৬৬), কাগজের নৌকা (১৯৬৬) ও ডাকবাবু (১৯৬৬) চলচ্চিত্রে ‘এক্সট্রা’ ও ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন।

জহির রায়হানের বেহুলা (১৯৬৬) চলচ্চিত্রে লখিন্দরের চরিত্রে অভিনয় করে এককালের এক্সট্রা রাজ্জাক রাতারাতি হয়ে গেলেন সুপারস্টার। ঢাকা পেল নতুন এক তারকা। তারপর রাজ্জাককে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ষাটের দশকের প্রবল রাজনৈতিক উত্তেজনা, লোকছবির উত্থান, পাকিস্তানি ও অন্যান্য ছবির ভিড়েও কখনো লোকগাথাভিত্তিক ছবিতে, কখনো সামাজিক, আবার কখনো গণ–আন্দোলনভিত্তিক ছবিতে সমান স্বাচ্ছন্দ্যে নায়ক চরিত্র করে গেছেন রাজ্জাক। স্বাধীনতাপূর্ব ঢাকার ছবি আনোয়ারা (১৯৬৭), নিশি হলো ভোর (১৯৬৮), বাঁশরী (১৯৬৮), ময়নামতি (১৯৬৯), নীল আকাশের নীচে (১৯৬৯), পীচ ঢালা পথ (১৯৭০), দর্পচূর্ণ (১৯৭০), মধুমিলন (১৯৭০), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) রাজ্জাককে খ্যাতি ও দ্যুতির তুঙ্গে নিয়ে যায়। রাজ্জাক হয়ে ওঠেন ঢাকার ছবির ‘নতুন উত্তমকুমার’। তাঁর রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে দর্শককুল।

কত ছবি কত নাম

রাজ্জাক অভিনীত ছবির সংখ্যা কত? ২০১৭-১৮ সালের একটি গবেষণা বলছে ৩২১, আবার ২০১৬ সালের এক দৈনিক পত্রিকায় লেখা হয়েছে, তাঁর ৪০০তম ছবি হচ্ছে বাবা কেন চাকর। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পাকিস্তান আমল পর্যন্ত (৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১) রাজ্জাকের ৪৯টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশ আমলে অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন। সংখ্যা যা-ই হোক, রাজ্জাক এ দেশের চলচ্চিত্রের নায়কদের মধ্যে শীর্ষতম। নিষ্ঠা, একাগ্রতা, শ্রম ও মেধা তাঁকে দিয়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্রে নায়করাজ অভিধা। 

চাষী নজরুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন (১৯৭২) দিয়ে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশে রাজ্জাকের অভিনয়যাত্রা। এ ছবিতে তিনি অনেকের মধ্যে একজন। তাঁকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে যায় জহিরুল হকের রংবাজ (১৯৭৩)। এ ছবিতে কবরীর বিপরীতে এক পকেটমারের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকপ্রিয়তা পান রাজ্জাক। তাঁর অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হচ্ছে আলোর মিছিল (১৯৭৪), বাঁদী থেকে বেগম (১৯৭৫), কি যে করি (১৯৭৬), অনন্ত প্রেম (১৯৭৭), পাগলা রাজা (১৯৭৮), বাজিমাত (১৯৭৮), অশিক্ষিত (১৯৭৮), মাটির ঘর (১৯৭৯), ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), আনারকলি (১৯৮০), মৌ–চোর (১৯৮১), রাজা সাহেব (১৯৮২), বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২), রজনীগন্ধা (১৯৮২), বদনাম (১৯৮৩), লাইলী মজনু (১৯৮৩), তালাক (১৯৮৪), অভিযান (১৯৮৪), চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), সৎভাই (১৯৮৫), শুভদা (১৯৮৬), স্বামী-স্ত্রী (১৯৮৭), যোগাযোগ (১৯৮৮), ঢাকা-৮৬ (১৯৮৮), বিরহ ব্যথা (১৯৮৯) ইত্যাদি।

১৯৬৬ থেকে ১৯৮০–র দশক পর্যন্ত ছবিতে নায়ক চরিত্র করেছেন রাজ্জাক। ১৯৯০–এর দশক থেকে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেন।

রাজ্জাকের নায়িকারা

অনেক নায়িকার সঙ্গেই জুটি বেঁধেছেন রাজ্জাক। বেহুলা (১৯৬৬) ছবিতে সুচন্দার সঙ্গে প্রথম জুটি। সুচন্দার সঙ্গে পরে আনোয়ারা (১৯৬৭), জুলেখা (১৯৬৭), দুই ভাই (১৯৬৮), সংসার (১৯৬৮), সখিনা (১৯৬৮), কুঁচবরণ কন্যা (১৯৬৮), মনের মত বউ (১৯৬৯), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন।

ঢাকার চলচ্চিত্রে সবচেয়ে সুপারহিট জুটি মনে হয় রাজ্জাক-কবরী। কবরীর সঙ্গে প্রথম ছবি নিশি হলো ভোর (১৯৬৮)। বাঁশরী (১৯৬৮) ছবিতে রোমান্টিক ইমেজে দেখা দেন এই জুটি। কাজী জহিরের ময়নামতি (১৯৬৮) ছবিতে তুঙ্গে ওঠে রাজ্জাক-কবরী জুটির জনপ্রিয়তা। বলা হয়, ময়নামতি রাজ্জাক-কবরীর প্রেম-বিরহের সার্থক ছবি। এই জুটির অন্যান্য ছবির মধ্যে রয়েছে নীল আকাশের নীচে (১৯৬৮), কখগঘঙ (১৯৭০), দর্পচূর্ণ (১৯৭০, দীপ নেভে নাই (১৯৭০), স্মৃতিটুকু থাক (১৯৭০), রংবাজ (১৯৭৩), বেঈমান (১৯৭৪), উপহার (১৯৭৫), গুন্ডা (১৯৭৫)
প্রভৃতি। 

শাবানা, ববিতা, শবনম, রোজিনা, সুচরিতা, অঞ্জনা, কাজরী প্রমুখের সঙ্গেও অনেক ছবিতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক। শাবানার সঙ্গে তাঁর মধুমিলন (১৯৭০), অবুঝ মন (১৯৭২), অতিথি (১৯৭৩), চাষীর মেয়ে (১৯৭৫), অমর প্রেম (১৯৭৭), অলংকার (১৯৭৮), মাটির ঘর (১৯৭৯), ছুটির ঘণ্টা (১৯৮০), পুত্রবধূ, রজনীগন্ধা প্রভৃতি ছবি স্মরণীয় হয়ে আছে।

সংসার (১৯৬৮) ছবিতে ‘সুবর্ণা’ নামে রাজ্জাকের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা। পরে পীচ ঢালা পথ (১৯৭০) ছবিতে রাজ্জাকের নায়িকা হন ববিতা। এই জুটির হিট ছবি বাঁদী থেকে বেগম (১৯৭৫), আকাংখা (১৯৭৬), অনন্ত প্রেম (১৯৭৭), অগ্নিপরীক্ষা (১৯৭৮), আনারকলি (১৯৮০), লাইলী মজনু (১৯৮৩) প্রভৃতি। 

অঞ্জনার সঙ্গে অশিক্ষিত ও দোয়েলের সঙ্গে চন্দ্রনাথ ছবিতে রাজ্জাকের অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। 

রাজ্জাক অভিনীত ও পরিচালিত অনন্ত প্রেম ছবির দৃশ্য

প্রযোজনা ও পরিচালনা

অভিনয়ের পাশাপাশি একসময় ছবি প্রযোজনাও শুরু করেন রাজ্জাক। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন’। এ প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে বেঈমান, অনন্ত প্রেম, সৎভাই, অভিযান, পাগলারাজা, মৌ–চোর

অনন্ত প্রেম (১৯৭৭) দিয়ে পরিচালনার খাতায়ও নাম তোলেন রাজ্জাক। তাঁর পরিচালিত অন্যান্য ছবির মধ্যে আছে মৌ–চোর, বদনাম, অভিযান, সৎভাই, জিনের বাদশা, প্রফেসর, উত্তর ফাল্গুনী, বাবা কেন চাকর, মরণ নিয়ে খেলা, আমি বাঁচতে চাই প্রভৃতি। 

রাজ্জাক তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মিত ছবির মাধ্যমে কাজরী, বাপ্পারাজ, সম্রাট প্রভৃতি নতুন মুখকে সুযোগ দিয়েছেন।

শেষ কথা

১৯৬৪ থেকে আমৃত্যু এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন রাজ্জাক। ছিলেন সামাজিক ছবির সর্বজনপ্রিয় অভিনেতা, ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন রোল মডেল। তিনি নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর চলচ্চিত্র। এসব ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখে আজও আপ্লুত হয় দর্শক। তাঁর ঠোঁটে যখন শুনি ‘আমি এক দুরন্ত যাযাবর’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’, ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’, ‘নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তা চলেছি একা’, তখন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চোখ ভিজে যায়।

অনুপম হায়াৎ: চলচ্চিত্র–গবেষক