আমি প্রথম আলোয় যোগ দিই এক বছরের চুক্তিতে। যোগ দিয়েই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইল ডিভাইসের উপযোগী আলাদা ওয়েবসাইট বানানো। একে তো আমি নতুন কর্মী, তার ওপর এত বড় কাজ (ওয়েবসাইট তৈরি) আমাকে একাই করতে হবে, তাই কিছুটা ভয় কাজ করছিল। তারপরও কাজ শুরু করে দিলাম। কাজ শেষে সাইটটি যখন লঞ্চ করা হলো, ভেতরে-ভেতরে একটু অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছিল। এর আগে যত প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, সবই ছিল ইউরোপ–আমেরিকার ক্লায়েন্টের কাজ। কিন্তু এ কাজ ছিল দেশের জন্য আর সবচেয়ে বড় কাজ। একসময় দেখা গেল, প্রথম আলো ডটকমের চেয়ে এম ডট ওয়েবসাইটে পাঠক প্রায় তিন গুণ বেশি, কিন্তু অনেক দ্রুত লোড হয়। রাস্তাঘাটে, বাসের ভেতর যখন দেখতাম পাশের সহযাত্রী মুঠোফোনে আমার বানানো ওয়েবসাইটে প্রথম আলোর খবর পড়ছেন, তখন খুবই ভালো লাগত। কখনো ইচ্ছা হতো জিজ্ঞেস করি, ভাই, ওয়েবসাইটটি কেমন?
এরপর প্রথম আলোর আরেকটি নতুন যুগের সূচনা হয়, প্রথম আলো ডিজিটাল। আগে ওয়েবসাইটে ম্যানুয়ালি ব্যানার দিয়ে বিজ্ঞাপন দেখানো হতো। আমরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিজ্ঞাপন দেখানোর ব্যবস্থা করলাম। এ জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। আমরা ডিজিটালের যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করে প্রয়োগ করতে থাকলাম। এতে নানা ধরনের ও চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দেখানোর ব্যবস্থা করা সম্ভব হলো। একই সময়ে জিও টার্গেট করে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখানো সম্ভব হলো। আর এভাবেই দেখতে দেখতে একটি বছর কেটে গেল।
তারপর আরও নানা রকম কাজ করতে থাকলাম। প্রথম আলো ইংরেজি ভার্সনের ওয়েবসাইট থাকলেও মোবাইল অ্যাপ ছিল না। ভাবলাম বানিয়ে ফেলি, কিন্তু আমি তো অ্যাপ বানানো জানতাম না। প্রথম আলো থেকে অ্যাপ তৈরি করার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। প্রশিক্ষণ নিয়ে বানিয়ে ফেললাম মোবাইল অ্যাপ। আর তাতে যুক্ত করলাম নানা রকম ফিচার।
বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট, সিটি করপোরেশন নির্বাচন—নানা কাজে সময় বয়ে যেতে থাকল। এরপর এল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে আমরাই প্রথম পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট তৈরি করি, যা দেশের বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়। এতে যুক্ত হয় ইন্টারেকটিভ ইনফোগ্রাফি। খুব কার্যকরভাবে ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারায় ওয়ান ইফরা থেকে আন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করে, যা আমাকে সত্যিই বিমোহিত করে। নির্বাচনের ওয়েবসাইট নিয়ে আমার এক বিশেষ ঘটনা মনে পড়ে। নির্বাচন কমিশনের বরাত দিয়ে সব গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় আওয়ামী লীগ এককভাবে পেয়েছে ২৫৯টি আসন। আমাদের প্রিন্ট পত্রিকাতেও তা–ই ছাপা হয়। কিন্তু আমাদের বানানো ওয়েবসাইটে দেখানো হচ্ছিল ২৫৮টি আসন, কেননা অন্যরা আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী ছিলেন। আমাদের সফটওয়্যারে বিজিত ও পরাজিত প্রার্থীর আলাদা আলাদা হিসাব ছিল। তাই এতে ভুল তথ্য দেখানোর কোনো সুযোগ ছিল না। দুই দিন পর নির্বাচন কমিশন সংবাদ সম্মেলন করে তাদের ভুল শুধরে নেয়। বিষয়টি আমাদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেয়।
বিভিন্ন উপলক্ষে আমরা পুরো টিম এক হয়ে যেভাবে কাজ করি, তা সত্যি অনেক ভালো লাগে। এবার আমরা প্রথম আলো প্রতিষ্ঠার ২৪তম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন করতে যাচ্ছি। প্রথম আলো ডটকম ঘিরে এবার নানা আয়োজনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু আনন্দ ও উদ্দীপনা সেই আগের মতোই, কিছু ক্ষেত্রে বরং বেশিই।
এভাবে কাজ করতে করতে বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। আসছে ডিসেম্বরে প্রথম আলোয় আমার ১০ বছরে পদার্পণ হবে। প্রথম আলোয় ১ বছরের জন্য যোগ দিয়ে প্রায় ১০ বছর কাটিয়ে ফেললাম। ভাবতেই অবাক লাগে, প্রথম আলোয় ১ বছর সমান ১০ বছর।
লেখক: ব্যবস্থাপক, তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ