রাত শেষে ভোরে রং ছড়ায় প্রথম আলো

প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

‘এখনো যায়নি?’, ‘আর কতক্ষণ’, ‘কী বাকি আছে?’, ‘ধুর মিয়া পারলেন না, আজও লেট’। শেষ মুহূর্তের এসব বকবকানি একসময় থামে। এর অর্থ হলো, প্রথম আলোর চরণধ্বনি বেজে উঠেছে। অর্থাৎ পত্রিকার প্রথম সংস্করণ ছাপার জন্য তৈরি। কম্পিউটার থেকে এক ক্লিকেই পত্রিকা প্রেসে, যে ব্যবস্থার পোশাকি নাম ‘সিটিপি’।

প্রেসে ছাপা হবে, ছাপার পর গাঁট বেঁধে গাড়িতে করে এই পত্রিকা খুব ভোরে পৌঁছে যাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ পাহাড়ি জনপদে, নোয়াখালী, কক্সবাজার অঞ্চলে। ‘হাসিমুখে’ কারও দরজার নিচ দিয়ে প্রবেশ করবে বৈঠকখানায়। কোনো পাঠক কিনে নেবেন স্টল থেকে। পড়বেন দিনের খবর, বিশেষ খবর, সম্পাদকীয়-মতামত, দেখবেন ঝকঝকে ছবি।

এই তো সেদিন, তবু এক-দেড় দশক তো হয়েছেই, সেলোফিন শিটের ওপর ট্রেসিং পেপার কেটে কেটে নিউজ বসানো হতো। আর আমাদের শামসুল হক ভাই সেলোফিন শিট নিয়ে ছুটতেন প্রেসে।

প্রথম আলোয় আমার প্রথম দিনগুলোয় রাতে প্রেসে গেছি বেশ কয়েক দিন। চেয়ারে বসে আছি। প্রেস ম্যানেজার খাতিরযত্ন করছেন, চা-বিস্কুট খাওয়াচ্ছেন। চোখের সামনে মেশিন থেকে বের হচ্ছে টাটকা প্রথম আলো। সে সময় একটা বাড়তি উত্তেজনা ছিল, এ কথা বলতেই হবে।

২.

রাত ১০টায় (কিংবা সোয়া ১০টা) প্রথম সংস্করণ যাওয়ার পরও বিরতি নেই। কারণ, পরবর্তী সংস্করণগুলো তো রয়ে গেছে। তবু কেউ কেউ গা এলিয়ে দেন ১৩ তলার সোফায়। কারও ফোন আসে, কেউ ফোন করেন। কেউ একটু আড়ালে গিয়ে চায়ের মগ হাতে নিয়ে ভিডিও কলে কথা বলেন স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে। কেউ ঘর থেকে আনা টিফিন বাটি খুলে বসেন।

১২ তলার বার্তাকক্ষে অবশ্য তখনো এতটা আড়ম্বর নেই। রিপোর্টিং বিভাগের চেয়ারগুলো খালি হয়ে গেছে। বার্তা বিভাগের ব্যবস্থাপকেরা অবশ্য রয়েছেন। আর বার্তা বিভাগের কর্মীরা তো প্রায় সবাই রয়ে গেছেন। থাকতে হয়। তখনো যে অনেক কাজ বাকি। দেশ-বিদেশের খবর আসা তো থেমে নেই। কী বাদ পড়ল, কী রয়ে গেল, আর নতুন যেসব খবর এসেছে, এর মধ্যে পত্রিকায় কয়টি ধরানো সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা, প্রয়োজনে তর্কবিতর্ক। বিকল্প সমাধান—‘অনলাইনে দিয়ে দেন।’

এরই এক ফাঁকে আমরা কজন একটু নিয়ম করে চা খেতে নামি। কারওয়ান বাজারের তখন ভরা সংসার। সারা দেশ থেকে সবজির ট্রাক আসা শুরু হয়েছে। টাটকা সবজির ঘ্রাণ নিতে নিতে চায়ের স্টলের দিকে এগিয়ে যাই। আলগা পাতি দিয়ে চা খাই, কিংবা একটুখানি কফি মিশিয়ে। সঙ্গে একটা নোনতা বিস্কুট, কিংবা একটা সাগরকলা আধাআধি ভাগ করে।

আবার তড়িঘড়ি করেই ১২ তলার বার্তাকক্ষে ‍ফিরে যেতে হয়। ততক্ষণে তেজগাঁওয়ের প্রেস থেকে চলে এসেছে ছাপা পত্রিকা; খানিক আগে প্রথম সংস্করণের যে পত্রিকা আমরা তৈরি করেছি। দেখতে কেমন হলো, ছবির ছাপার মান ঠিক আছে কি না, এসব নানা জিনিস দেখা। এর আগেই অবশ্য রাজধানী সংস্করণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের বার্তা বিভাগের সহকর্মীরা সমস্ত পত্রিকা পড়ে শেষ করেছেন।

সংবাদপত্র-সংশ্লিষ্ট মানুষেরাই কেবল তা জানেন। সামান্য একটু ভুলে বরবাদ হয়ে যেতে পারে সমস্ত ভালো প্রচেষ্টা। যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেশি থাকে, তাদের ন্যূনতম ত্রুটিবিচ্যুতিও তারা মেনে নিতে পারে না।

এ সময় একটি দলকে ১২ তলায় রেখে উঠে যাই ১৩ তলায়, যেখানে রয়েছে গ্রাফিকস বিভাগ। আছে সম্পাদনা সহকারী বিভাগ, লোকে যাকে প্রুফ বিভাগ বলে চেনে। সেখানে তখন অভাবনীয় দৃশ্য। সব কটি পাতার ‘এ-থ্রি’ প্রিন্ট নেওয়া হয়েছে আগেই। প্রত্যেকের হাতেই একটি করে পাতা। মনোযোগী ছাত্রের মতো হাতে লাল কালির কলম নিয়ে সম্পাদনা সহকারী বিভাগের কর্মীরা পাতা পড়ছেন, দাগ দিচ্ছেন। বার্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মীদের সঙ্গে আলোচনার পর প্রয়োজনে তা সংশোধন করা হচ্ছে। এ দায়িত্ব যে কত জরুরি, সংবাদপত্র-সংশ্লিষ্ট মানুষেরাই কেবল তা জানেন। সামান্য একটু ভুলে বরবাদ হয়ে যেতে পারে সমস্ত ভালো প্রচেষ্টা। যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেশি থাকে, তাদের ন্যূনতম ত্রুটিবিচ্যুতিও তারা মেনে নিতে পারে না। এটাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখি। তাই সম্পাদনা সহকারী বিভাগের এই মানুষগুলোর প্রতি ভালোবাসা চলে আসে মন থেকে।

৩.

নগর সংস্করণ শেষ করার নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। তাই রাত যত গভীর হয়, গ্রাফিকস বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মীদের মুখে ‘ভাই ছাড়েন না, ছাড়েন না, আর কতক্ষণ’—এ সংলাপ বারবার আসতে থাকে। কারণ, প্রেস থেকে ফোনটা তাঁদের কাছেই আসে।
একটি নির্ভুল পত্রিকা তৈরির দায়িত্ব প্রধানত বার্তা বিভাগের। রাতে পত্রিকাসংক্রান্ত কারিগরি-অকারিগরি যত কাজ আছে, সব কর্তৃত্বই তাঁদের।

তবে পত্রিকা তৈরির বড় কাজটি—পৃষ্ঠাসজ্জা করা, ছবি সম্পাদনা, ভিজ্যুয়াল আর্ট তৈরি—গ্রাফিকস বিভাগের কর্মীরাই করেন। কিন্তু আনন্দের বিষয় হলো, নির্ভুল পত্রিকা করার জন্য সাংবাদিকদের যেসব কাজ, সেখানেও তাঁরা দায়িত্ব পালনে পিছপা হন না। সহায়তা করেন, প্রয়োজনে মতামত দেন।

মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। সেদিন রাতে দেখলাম, আমাদের গ্রাফিকস বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মীটি তাঁর অবস্থান থেকে সব যাচাই করছেন, তদারক করছেন, যেটি তাঁর না করলেও বিশেষ কোনো অসুবিধা ছিল না। আর সন্ধ্যায় দেখেছিলাম তিনি ঠান্ডাজ্বরে আক্রান্ত।
এভাবেই আমরা কাজ করি। প্রতি রাতে এভাবেই কাজ শেষ হয়। রাত শেষে ভোরে রং ছড়ায় প্রথম আলো।

কাজী আলিম-উজ-জামান, উপবার্তা সম্পাদক, সমন্বিত বার্তা বিভাগ