প্রথম আলোর আলোকচিত্রীদের তোলা ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছে একাধিকবার। জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানের প্রতীক এই ছবিগুলো। ঝুঁকিপূর্ণ সেই সময়ে ছবি তোলার মুহূর্তের কথা লিখেছেন আলোকচিত্রীরা
এক হাতে তোলা ছবি
দীপু মালাকার
আমরা কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনের মাঠে অবস্থান নিয়েছি। আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মুখোমুখি। সেই ছবি তুলছিলাম। দুই পক্ষই ইটপাটকেল নিক্ষেপ করছিল। হঠাৎ বিজয় একাত্তর হলের ভেতর থেকে একটি বড়সড় ইটের টুকরা এসে আমার বাঁ হাতে লাগে। হাতটি নামিয়ে দেখলাম, কবজির ওপরে বেশ বেশ বড় আঘাত লেগেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। এক সহকর্মী তাঁর সঙ্গে থাকা স্যানিটাইজার আমার আঘাতপ্রাপ্ত অংশে লাগিয়ে দেন।
তখনো চলছে ছাত্রলীগের তাণ্ডব। হকিস্টিক, রামদা দিয়ে চড়াও হয়েছেন আন্দোলনকারীদের ওপর। ব্যথা ভুলে আবারও শুরু করলাম ছবি তোলা। একপর্যায়ে বিকেল পৌনে চারটার দিকে আন্দোলনকারীরা পিছু হটে ফুলার রোড ও নীলক্ষেত মোড়ের দিকে ছুটতে থাকেন। তখন সামনে যাঁকে পান, তাঁকেই মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় মল চত্বরে আন্দোলনে যুক্ত অনেক ছাত্রীও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মারধরের শিকার হন। আমার হাতের ব্যথাও তীব্র হচ্ছিল। মল চত্বরের সড়ক বিভাজকে দাঁড়িয়ে এক হাতেই ছবি তুলছিলাম। তখন পালিয়ে যাওয়ার সময় দুজন ছাত্রীকে মারতে উদ্যত হচ্ছিলেন এক ছাত্রলীগ কর্মী। ছাত্রী দুজনের চোখেমুখে ছিল আতঙ্ক। এক হাতেই তুলে ফেলি ছবিটা।
ছেলেটি বেঁচে ছিল
তানভীর আহম্মেদ
হানিফ ফ্লাইওভারে যাত্রাবাড়ীতে নামার প্রান্তে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সড়কে পড়ে আছেন এক আন্দোলনকারী। একদিকে পুলিশ গুলি ছুড়ছিল, অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেল। এর মধ্য দিয়েই ছেলেটার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি। কাছে যাওয়ার পর তাঁকে দেখে মনে হয় মারা গেছেন। তাই সরিয়ে নিতে পুলিশ সদস্যদের বলতে থাকি, ‘ভাই, এখানে একজন মানুষ পড়ে আছেন।’
আমার গলার আওয়াজ শোনার পর সড়কে পড়ে থাকা ছেলেটি হাত তোলেন। তাঁর সেই মুহূর্তের ছবি তুলতে তুলতেই আমি আবারও বলি, ‘ভাই, উনি এখনো বেঁচে আছেন, তাঁকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।’ পরে আহত ছেলেটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পুলিশের ভ্যানের সামনে
শুভ্র কান্তি দাশ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ নামের পদযাত্রা কর্মসূচি ছিল। হাইকোর্টের সামনের দিকে পুলিশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করে। আটক এক শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন আরেক শিক্ষার্থী। আটক শিক্ষার্থীকে পুলিশ ভ্যানে তোলার পর এক শিক্ষার্থী ভ্যানটির সামনের দিকে দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে পড়েন। আমি সেই ছবি তুলতেই দেখি নারী পুলিশ সদস্যরা তাঁকে টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেন। এই আন্দোলনকারীর নাম ছিল নুসরাত।
বাসায় না গেলে বড় ক্ষতি হবে
সাদ্দাম হোসেন
খুলনার সিটি কলেজের সামনে তখন সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। রয়েল মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিজন ভ্যানে ছাত্রদের ধরে এনে ওঠানো হচ্ছিল দেখতে পেয়ে এগিয়ে যাই। ঠিক তখনই প্রিজন ভ্যানের জানালা থেকে এক তরুণী সাংবাদিক দেখে বলতে থাকেন, বাসায় না গেলে বড় ক্ষতি হবে তাঁর।
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আমি তাঁকে কী বলব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে অসহায় তরুণীর ছবিটা তুলি।