দুর্নীতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীর উন্নত কিংবা অনুন্নত সব দেশেই কমবেশি দুর্নীতির প্রবণতা দেখা যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বিগত সময়ে বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ছড়িয়েছে বহুলাংশে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় এই যে বাংলাদেশে দুর্নীতি সামাজিকভাবে গৃহীত এবং সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে।
কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক; ১. পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন খেলার ফাইনাল ম্যাচে প্রধান অতিথি করা হয় সবচেয়ে বেশি অনুদান প্রদান করতে পারবেন, এমন ব্যক্তিকে, তিনি প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতিবাজ হলেও এতে আয়োজকদের ভ্রুক্ষেপ করার কিছু থাকে না।
২. খাদ্য বিভাগে অনেক কর্মকর্তা প্রমোশন নিয়ে ঊর্ধ্বতন পদে যেতে চান না; কারণ, উক্ত পদে ঘুষ খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা থাকে না।
৩. বিয়ের ক্ষেত্রে এখনো পাত্রীপক্ষ পাত্রের উপরি আয় আছে কি না, সেটি যাচাই করে দেখে। বর্তমান সময়ে সরকারি/বেসরকারি চাকরিতে অথবা কোনো সেবা গ্রহণকারী/প্রদানকারী ব্যক্তি ঘুষ প্রদান অথবা গ্রহণ করতে না পারাকে অনেকটা আনস্মার্টনেস হিসেবে দেখা হয়।
তাই আমরা সবাই স্মার্টনেস ধরে রাখার জন্য ছেলেমেয়ের স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে ডাক্তারের সিরিয়াল দেওয়া, পাসপোর্ট বানানো, জন্ম-মৃত্যু সনদ লাভ, পেনশন ওঠানো, কোভিড সার্টিফিকেট উত্তোলন, ড্রাইভিং লাইসেন্স বানানো, পাবলিক পরীক্ষার অগ্রিম প্রশ্ন নিতে ঘুষ দেওয়া বা নেওয়ার এই ফ্যাশন অনুসরণ করছি। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত একজন বাংলাদেশি নাগরিকের যাপিত জীবনে এ ফ্যাশন অবজ্ঞা করা দায়।
এ জন্য অবশ্য আমরা নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতিকেও কিছুটা দায়ী করি। কেননা দিনে দিনে আমাদের চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, সেই সঙ্গে আছে পারিবারিক চাপ। তাই দুর্নীতি না করে উপায় কি? আমাদের মধ্যে দুর্নীতি সম্পর্কে একধরনের দ্বিচারিতা রয়েছে (একদিকে দুর্নীতিকে ঘৃণার চোখে দেখা আবার প্রয়োজনে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া) এবং আমরা এর মায়াজালে আবদ্ধ। বলা যায় দুর্নীতি বাংলাদেশে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।
বলা যায় দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা সত্ত্বেও বিগত এক দশকে বাংলাদেশে ঈর্ষান্বিত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু, বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন হয়েছে। আরও কিছু মেগা প্রজেক্ট যেমন; কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল সংযোগ, গভীর সমুদ্রবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর, ইত্যাদি উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছে।
এ ধরনের উন্নয়ন অনেকটা ষাট এবং সত্তরের দশকের সিঙ্গাপুর ও হংকংকে মনে করিয়ে দেয়, যাকে উন্নয়ন বিশ্লেষকেরা দুর্নীতির ফাংশনাল অ্যাপ্রোচ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। কেননা বাংলাদেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তা কোনোভাবেই দুর্নীতির ঊর্ধ্বে নয়। কারণ, অধিকাংশ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে কমবেশি দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়।
সরকারি কাজে ব্যয়বৃদ্ধি একটি নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে, তা ছাড়া অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশে পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়। এর চেয়েও বেশি বিপজ্জনক বিষয় দেশ থেকে মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার। এর সঙ্গে আছে সরকারি আমলা ও রাজনীতিবিদদের দেশের বাইরে সম্পত্তি গড়ে তোলা।
ফলে যে উন্নয়নের চিত্র আমরা দেখছি, তার ফলাফল সাধারণ জনগণের জন্য সাময়িকভাবে ভালো হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি কী হবে, তা নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয়।
ইতিমধ্যে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মধ্যবিত্তের সংখ্যাও দিনে দিনে কমছে। কিন্তু একটি টেকসই সমাজ বিনির্মাণে মধ্যবিত্তের ভূমিকা অপরিসীম, যা কি না দুর্নীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এবং প্রতিষ্ঠানকে সুসংহত করতে পারে।
বিগত দশকে বাংলাদেশে দুর্নীতি দমনের প্রচেষ্টাকে একেবারে খাটো করে দেখারও সুযোগ নেই। সীমাহীন দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নানাভাবে ঢেলে সাজানো হয়েছে। যদিও কমিশনের ভূমিকা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
এ ছাড়া সরকার ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে জনপ্রশাসনে দুর্নীতি রোধে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ টু আইয়ের (এ পায়ার টু ইনোভেশন) মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন সেবা খাতে একাধিক উদ্যোগ বেশ প্রশংসনীয়। এর মধ্যে ভূমি ব্যবস্থার উন্নয়নে ই-মিউটেশন অন্যতম। একই সঙ্গে বিভিন্ন সেক্টরে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কিছুটা দূর করতে সক্ষম হয়েছে, তা ছাড়া দুদক ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় গণশুনানি ও দুর্নীতিবিরোধী প্রচারের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে।
তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ বলা যায় ২০১২ সালে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কাগজে-কলমে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল সরকারের অন্যতম প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যা দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয়।
এই শুদ্ধাচার কৌশলের আওতায় সরকার মোট ১৬টি (১০টি রাষ্ট্রীয় এবং ৬টি অরাষ্ট্রীয়) পিলারকে অন্তর্ভুক্ত করে যার মধ্যে রয়েছে নির্বাহী বিভাগ ও জনপ্রশাসন, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, ন্যায়পাল, দুর্নীতি দমন কমিশন, স্থানীয় সরকার, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি খাতের শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও সুশীল সমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম।
এ ছাড়া ২৬টি সেক্টরের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে এর সমাধানে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ঠিক করা হয়। এ ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মক্ষেত্রে শুদ্ধাচার বজায় রাখার জন্য শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। (বিস্তারিত দেখুন- https://rb.gy/bu9qt) এই ধরনের বৃহৎ কর্ম পরিকল্পনা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার এবং এর বাস্তবায়ন দুর্নীতিকে প্রশমিত করবে।
কিন্তু কার্যত শুদ্ধাচার কৌশলের প্রয়োগ সীমিত। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অ্যানুয়াল-পারফরম্যান্স-অ্যাপ্রাইজাল ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে এর বাস্তবিক প্রয়োগ সীমিতই দেখা যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল সম্পর্কে খুব কমসংখ্যক মানুষই অবহিত। এ ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রচারণা ও উদ্যোগ সীমিত আকারেই দেখা গেছে।
যাহোক, দুর্নীতি দমনে সরকারের কিছু প্রচেষ্টা থাকলেও কার্যত তা ক্ষুদ্র দুর্নীতি ও সেবা খাত কেন্দ্রিক। কিন্তু বড় দুর্নীতি রোধে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা নেই বললেই চলে, যার ফলে সরকারের অনেক সাফল্য ম্লান হয়েছে। বিগত কিছু বছর দুর্নীতির ধারণা সূচকে (সিপিআই) কিছুটা অগ্রগতি হলেও বড় দুর্নীতি রোধে ব্যর্থতা সরকারকে নানা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ জন্য অনেক গবেষক বাংলাদেশের এহেন পরিণতির জন্য তষ্করতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনকে (ক্লিপ্টোক্রাটিক স্টেট ক্যাপচার) দায়ী করেছেন, যার কারণে সরকারের নানা উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখতে পাচ্ছে না।
সামগ্রিক আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মাণ যে দুর্নীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই এর প্রতিকার অর্থাৎ দমন কখনোই সম্ভব নয়। সত্যিকার অর্থে দুর্নীতি দমন করা পৃথিবীর কোনো দেশেই একেবারে সম্ভব নয়। তবে এর প্রবণতা কমানো যেতে পারে, যার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
ফিলিপাইনে ফার্দিনান্দ মার্কোস ১৯৬৫-৮৬ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। নিজে দুর্নীতিপরায়ণ হলেও মার্কোস একসময় বুঝতে পারেন যে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে দুর্নীতি প্রশমনের বিকল্প নেই। তাই তিনি বিচারপতি ইফরেন আই প্ল্যানাকে প্লেনাকে ব্যুরো অব ইন্টারনাল রেভেন্যুর প্রধান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এজেন্ট-প্রিন্সিপাল রিলেশনশিপের মাধ্যমে ফিলিপাইনের দুর্নীতি প্রশমনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।
প্ল্যানা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ত্রুটি খুঁজে বের করেন এবং তা সমাধানকল্পে কিছু সৎ ও চৌকস কর্মকর্তাদের ওপর নজরদারির মাধ্যমে তাদের নিয়োগ দেন। সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তিনি প্রতিটি খাতে একের পর এক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনির্মাণ করেন।
এই কেস স্টাডির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তাই দুর্নীতি প্রশমনে সবার আগে সরকারের/সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
একই সঙ্গে যেসব দুর্নীতি দমন প্রচেষ্টার কথা আমি উল্লেখ করেছি, তার সব কটিই ছিল দাতা সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত অথবা বিদেশি নির্ভরতায়, যা বাংলাদেশের জন্য চাপিয়ে দেওয়া এবং আমাদের নীতিনির্ধারকরা এগুলো বাস্তবায়নে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তাই দুর্নীতি প্রশমনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিজস্ব উদ্যোগ (হোম গ্রোন ইনিশিয়েটিভ) যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
বাংলাদেশের শুদ্ধাচার কৌশলের অন্যতম একটি আশাব্যঞ্জক দিক হচ্ছে পরিবারকে একটি অরাষ্ট্রীয় স্তম্ভ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। যেহেতু দুর্নীতি বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে, তাই পরিবারের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সামাজিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করা অতি জরুরি।
আশার কথা আমরা একটি যৌথ সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করি। তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কমিউনিটি পর্যায়ে পরিবারকেন্দ্রিক নীতিশিক্ষা অতিপ্রয়োজনীয়। প্রয়োজনে এর সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় করা যেতে পারে। এটা সম্ভব হলেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে। তা না হলে আমরা আটকে থাকব উন্নয়নের বেড়াজালে।
নুরুল হুদা সাকিব: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক।