জুলাই–আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন কয়েক শ মানুষ। তাঁদের কারও হাত, কারও পা কেটে ফেলতে হয়েছে। অনেকে এখনো হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ঘটে চলা এসব ঘটনা একজন সংবাদকর্মী হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখতে হয়েছে। সেই দিনগুলো যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে এসেছিল আমার কাছে।
সাভারে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, ৬ জুন। সেদিন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালে আদালতের দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন একদল শিক্ষার্থী। এরপর তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন। সাভার ও আশপাশের এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তীব্রতা শুরু হয় ১৪ জুলাইয়ের পর। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তীব্রতর হতে থাকে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর বাধা সত্ত্বেও ক্যাম্পাসে, মহাসড়কে নিয়মিত বিক্ষোভ চলতে থাকে। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ।
১৫ জুলাই বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মিছিলে বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে ওই রাতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। সেখানেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। শুরুতেই দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে আসা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ছোড়া একটি পেট্রলবোমা এসে পড়ে আমার ঠিক সামনেই। রামদা হাতে থাকা হামলাকারীদের কিছু ছবি তোলায় মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে তা মুছে ফেলেন তাঁরা। ছাত্রলীগের হামলা থেকে বাঁচতে উপাচার্যের বাসভবন প্রাঙ্গণে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। সেখানেও সশস্ত্র হামলার মুখে আহত শিক্ষার্থীরা যে আর্তচিৎকার করেন, তা বাসভবনের ভেতর থেকে শোনেন উপাচার্যসহ অনেক শিক্ষক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ওই সময় ছাত্রলীগের ইটপাটকেল আর পেট্রলবোমার ভয়ে আতঙ্কিত শিক্ষার্থীদের রক্ষায় হাতে গোনা কয়েকজন শিক্ষক প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিলেন। একপর্যায়ে বিভিন্ন হল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের পাল্টা ধাওয়ার মুখে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা চলে যান।
একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পুলিশ সদস্যদের ওপর চড়াও হন তাঁরা। তখন ক্যাম্পাসে কর্মরত এক সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে মারমুখী শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে তিন পুলিশ সদস্যকে নিরাপদে সরিয়ে নিলাম। ওই পুলিশ সদস্যদের ভয়ার্ত চোখ দেখে কষ্টও হয়েছিল সেদিন। এরপরই আবার মারমুখী হয়ে ওঠে পুলিশ। ওই রাতেই তাদের ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল আর ছররা গুলিতে ক্যাম্পাসে কর্মরত সাংবাদিক মেহেদী মামুন, আব্দুর রহমান খান, অধ্যাপক মোহাম্মদ লুৎফুল এলাহীসহ আন্দোলনকারী অনেকে আহত হন। উপাচার্যের বাসভবন প্রাঙ্গণে আহত অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ-উল-হাসানকে সেদিন অসহায় শিশুর মতো পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। তাঁকে তোলার সময় আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন।
এরপর থেকে সাভারের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র ও বিভিন্ন দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা চালান। ১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সাভার ও আশুলিয়ায় আন্দোলনের সময় ছররা গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনকে পুলিশের সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে ফেলে দেওয়া; পুলিশ ভ্যানে তুলে লাশে আগুন দেওয়া; হত্যার পর পুলিশ সদস্যদের লাশ উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা; শারীরিক প্রতিবন্ধী, শিশু, দিনমজুর, পোশাককর্মী, দোকানকর্মী নিহতের ঘটনাগুলো মানবিকতা ও মানবাধিকারের চরম বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরে।
আন্দোলনের সময় সাভার ও আশুলিয়ায় আমরা যাঁরা সংবাদ সংগ্রহের কাজ করেছি, তাঁদের প্রতিনিয়তই নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত বিভিন্ন স্থানের বিক্ষোভকারীদের অনেকে ছবি তোলা, ভিডিও ধারণ করাসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতেও বাধা দেন। তাঁদের মারধরের শিকার হন কয়েকজন সাংবাদিক। সংবাদকর্মীর মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ তৎকালীন সরকার সমর্থকদের হামলার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে লাঠিপেটা, মারধরের শিকার হতে হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ জুলাই দায়িত্ব পালকালে প্রথম আলোর প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বেধড়ক মারধর করে পুলিশ। আত্মরক্ষার্থে এক পর্যায়ে দৌড়ে সেখানে থেকে সরে যাওয়ার সময় মামুন ও তাঁকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসা অন্য সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছোড়ে পুলিশ। সাভারেও ৫ আগস্ট পুলিশের ছররা গুলিতে শরীরের বিভিন্ন অংশসহ ডান চোখে আঘাত পান সাংবাদিক সৈয়দ হাসিবুন নবী। আশুলিয়ায় আহত হন আরেক সাংবাদিক লোকমান হোসেন চৌধুরী। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সময়ে মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে অফিসে সংবাদ পাঠাতে ভীষণ বেগ পেতে হয়।
* শামসুজ্জামান: নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো